হিসাব বিজ্ঞানে না পড়েও তিনি পৌর হিসাবরক্ষক!
পড়াশোনা মানবিকে হলেও চাকরি করছেন পৌরসভার হিসাবরক্ষণ হিসেবে!পেয়েছেন পদোন্নতিও!
মোঃ শফিকুল ইসলাম ভূইয়া,
গাজীপুর।
গাজীপুর মহানগরের বনমালা সড়কের পাশে জমি কিনে মার্কেট নির্মাণ করছেন ইদ্রিস আলী।
ছবি: সংগৃহীত।
লেখাপড়া করেছেন মানবিক বিভাগে, অথচ তিনি এখন পৌরসভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। চাকরিবিধি উপেক্ষা করে একের পর এক নিয়েছেন পদোন্নতি। শুধু কি তাই, চাকরিকালীন নানা অনিয়ম দুর্নীতি করে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এখন গাজীপুরে অনেকটা ওপেন সিক্রিট। চলতি বছরেই তার অবসরে যাওয়ার কথা। ইদ্রিস আলী গাজীপুর মহানগরের তরৎপাড়া এলাকার করম আলীর ছেলে। তিনি শ্রীপুর পৌরসভায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে কর্মরত রয়েছেন।
পৌরসভা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইদ্রিস আলী মানবিক বিভাগ থেকে বিএ উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৬ সালে গাজীপুর পৌরসভায় কর আদায়কারী পদে নিয়োগ লাভ করেন। এ পদের যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক পাস। পরে কর আদায়কারী পদে চাকরি করার সময়ই ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাকে কোষাধ্যক্ষ পদে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে আত্তীকরণ করা হয়।
পৌরসভার চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, কোষাধ্যক্ষ পদে চাকরি করার জন্য প্রার্থীকে বাণিজ্যে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। এ ছাড়া এ পদে সরাসরি ১০০ ভাগ লোক নিয়োগ করার শর্ত রয়েছে।
শর্তভঙ্গ করে পরে ইদ্রিস আলী গাজীপুর পৌরসভায় পরে ২০০১ সালে পদোন্নতি নিয়ে হিসাবরক্ষক হন। দীর্ঘদিন সেখানে চাকরি করার পর ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি শ্রীপুর পৌরসভায় যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে ২০১৮ সালে ইদ্রিস আলীকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
পদোন্নতি দিয়ে সেখান থেকে জামালপুর পৌরসভায় বদলি করা হলেও ২০১৯ সালে আবারও তিনি শ্রীপুর পৌরসভায় যোগ দেন। গাজীপুর পৌরসভায় চাকরিকালীন তার বিরুদ্ধে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাতের অভিযোগও ছিল।
আর শ্রীপুর পৌরসভা থেকে বিভিন্ন ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার হাত ধরেই শ্রীপুর পৌরসভায় নানা অনিয়ম হয়। পুরো বিষয়টি জেনেও অনেকটা রহস্যময় ভূমিকায় স্থানীয় সরকার বিভাগ।
গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদও
ইদ্রিস আলীর বাবা একজন কৃষক। তিন ভাইয়ের সংসারে এক সময় অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তবে পৌরসভার চাকরির কল্যাণে আজ কোটি টাকার মালিক। ইদ্রিস আলী তার চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় শ্রীপুরে কর্মরত। চাকরিকালীন ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্থানে জমি, গাড়ি, বাড়ি করেছেন।
শ্রীপুর উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ মাওনা চৌরাস্তায় তিনি ২০১১ সালে ১৭২১০ নম্বর ও ২০৮৫৩ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ১২ শতাংশ জমি কেনেন। সেখানে অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে বাগান বাড়ি তৈরি করেন। দীর্ঘদিন কোনো ভাড়া না দিয়ে বাড়িটিতে মাঝে মধ্যে বিশ্রামের কাজে ব্যবহার করতেন। সম্প্রতি তিনি বাড়িসহ জমিটি ৭০ লাখ টাকা বিক্রি করলেও বিক্রিকৃত ৮৩৭৭/২২,১৮৯৬৯/২২ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ২৯ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে বাকি টাকার তথ্য গোপন করেন।
গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রম এলাকায় বনমালা সড়কের পাশে ২৪ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনে তিনি সেখানেও কোটি টাকা ব্যয়ে মার্কেটও নির্মাণ করেছেন। ইতোমধ্যেই একতলার কাজ শেষ হয়েছে। গাজীপুর শহর ও এর আশপাশ এলাকায় তার আরও বেশ কিছু জমি ও বাড়ি থাকার তথ্য রয়েছে। শ্রীপুরের উজিলাব মৌজায় স্থানীয় খোরশেদ কেরানীর ছেলে রতন মিয়ার কাছ থেকেও তিনি অর্ধকোটি টাকা ব্যায়ে বেশ জমি কিনেছিলেন। যদিও পরে তিনি জমিটি বিক্রি করে দেন।
তার ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ ৪২-৬১২১। তার চালকের বেতন ১৫ হাজার টাকা। গাজীপুর শহর থেকে শ্রীপুরে অফিস করতে এলেও বিশ্রামের জন্য পৌরসভা সংলগ্ন সাব্বির আহমেদ মোমতাজীর বাসা নিয়েছেন। সেখানে তাকে প্রতিমাসে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে তার খরচ লাখ টাকার উপরে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে ফোন দেওয়া হলে ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমার বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানে। আমার চাকরি নিয়ে বহু কিছু হয়েছে, কেউ কিছুই করতে পারেনি। আর কয়েকমাস চাকরি আছে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পৌর-১ কবির হোসেন বলেন, ‘মানবিক বিভাগে পড়ালেখা করে কিভাবে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হলো বা কর্তৃপক্ষ কিভাবে তাকে পদোন্নতি দিল এসব বিষয়ে না দেখে কিছু বলা যাবে না।’ এ সময় পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন তিনি।