অভাব নয় অতিমাত্রায় লোভী মানুষই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইতালিতে যায়

0
46

লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালিতে যাওয়ার পথে যে বাংলাদেশীরা মারা যায়, এদের কেবল ক্ষুদ্র একটা অংশই সত্যিকারের অভাবের তাড়নায় দেশ ছেড়ে এই মৃত্যুফাঁদে পা দেয়। এর বাইরে অধিকাংশই মারা যায় অতিরিক্ত লোভ করতে গিয়ে, বোকামির কারণে অথবা অনর্থক রিস্ক নিয়ে।

ইতালিতে যাওয়া সব সময় কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তারপরেও বাংলাদেশীরা হাজারে হাজারে সেখানে গিয়েছে। আমাদের পরিচিত অনেকেই গিয়েছে। এদের প্রায় কেউই না খেয়ে মরার মতো অবস্থায় ছিল না।

ইনফ্যাক্ট অনেকেই আছে, যারা ১০-১৫ বছরের নিয়মিত রোজগার বা নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে ইতালিতে গেছে, কারণে তারা শুনেছে ইতালির আকাশে-বাতাসে টাকা ওড়ে। সেখানে গেলে বছরের পর বছর বিদেশ করা লাগবে না। দুই বছরেই বাড়ি-গাড়ি করে ফেলা যাবে।

লিবিয়াতে চাকরিজীবিদের আয় কম। বরং বিভিন্ন দক্ষ পেশাজীবিদের আয় অনেক বেশি। এমন অনেক বাংলাদেশীকেও ইতালিতে যেতে দেখেছি, যাদের আয় একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার যা আয়, তার দ্বিগুণেরও বেশি। ইনফ্যাক্ট আমার নিজেরই একজন রিলেটিভ আছে, যার আয় সেসময় আমার চেয়েও বেশি ছিল, সেও ইতালিতে চলে গেছে।

এই যাত্রাপথে আমাদের পরিচিত অনেকে মারাও গেছে। অনেকে মরতে মরতে বেঁচেছে। এবং তারাও এমন সিরিয়াস অভাবী ছিল না, যার কারণে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে হবে। তারা শুনেছে ইতালিতে গেলে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করা যায়। আর কোনো কাজ না থাকলেও ফ্রি ভাতা পাওয়া যায়। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায়নি, তাতে না হয় একটু রিস্ক থাকলই।

২০১৬ সালের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের দেখা পেয়েছিলাম, যে বাংলাদেশের বিখ্যাত কোনো একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় (নর্থ-সাউথ বা ইস্ট-ওয়েস্ট বা এই জাতীয় কিছু, মনে পড়ছে না) থেকে পাশ করে বেরিয়েছিল। দেশে তার আর্থিক অবস্থাও মোটামুটি ভালো ছিল।

তারপরেও সে লিবিয়াতে এসেছে, কারণ সে শুনেছে যুদ্ধের পর লিবিয়াতে এখন কনস্ট্রাকশনের কাজে ইঞ্জিনিয়ারদের প্রচুর চাহিদা। অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। গতবছর সে ফেসবুকে হঠাৎ যোগাযোগ করল, সে ইতালিতে পৌঁছে গেছে। অথচ তখনও ট্রলারডুবি হয়ে মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত ছিল। এই রিস্ক সে অভাবের তাড়নায় নেয়নি। নিয়েছে ইউরোপ নামের স্বর্গের জীবনের আশায়।

লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়া ন্যাশনালিটি যদি দেখেন, দেখবেন নাইজার, মালি, ইরিত্রিয়া – এসব দেশের নাগরিক। এদের সবার দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশে থাকলে যেকোনো বাহিনী জোর করে সেনাবাহিনী বা মিলিশিয়াতে ঢুকিয়ে দিবে। তারপর এমনিতেই মারা যাবে। সুতরাং তারা যদি ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে চায়, সেটার একটা অর্থ আছে।

কিন্তু বাংলাদেশীরা? এরা একেকজন ১০ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট করে লিবিয়াতে আসছে ইতালিতে যাওয়ার জন্য। এই ১০ লাখ টাকা দিয়ে কি দেশে কিছুই করা যায় না? জীবনের মূল্য ১০ লাখ টাকার চেয়েও কম?

তাও যদি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে আসত! গত এক বছরে যে ইতালিতে যাওয়ার হার প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে, প্রতিটা নৌকাকে যে লিবিয়াতেই আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে, এরা সেই খবরটাও নিয়ে আসছে না।

যারা সফলভাবে ইতালিতে পৌঁছেছে, তাদের কাছ থেকে সাফল্যের মোটিভেশনাল স্টোরি শুনেই এরা ইউরোপ নামের স্বর্গের আশায় ছুটছে। কিন্তু কত মানুষ যে ব্যর্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে, তাদের গল্পগুলো এরা শুনছে না।

ফলাফল, গণহারে লিবিয়ার জেলগুলোতে বন্দী হচ্ছে, আটক হচ্ছে, এরপর দালালদের মার খেয়ে দেশে টাকা দিয়ে হয়তো ছাড়া পাচ্ছে বা সর্বশান্ত হয়ে আবার দেশে ফিরে যাচ্ছে।

প্রতিটা মৃত্যুই দুঃখের, প্রতিটা মৃত্যুই অনাকাঙ্খিত। এবং কিছু মানুষ হয়তো সত্যিই ভীষণ বিপদে পড়েই এই পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে মানুষের নিজেরও দায় আছে। রিস্ক ফ্যাক্টরটা তো দেখতে হবে! ইউরোপ স্বর্গ, সেই স্বর্গে পৌঁছার জন্য জীবনকে তুচ্ছ করে ছুটে যেতে হবে?

কোন মন্তব্য নেই