দুর্নীতি দমনে ইসলামের নির্দেশনা

0
72

জি নিউজ ডেস্কঃ আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। এসব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হলো সেরা সৃষ্টি। এদের আল্লাহ তাআলা উচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি মানবজাতিকে পরিচ্ছন্ন, পবিত্র, পাপমুক্ত ও নিষ্কলুষ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, সে পবিত্র ও পাপমুক্ত অবস্থায় আসে। পরবর্তী সময় পৃথিবীর পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, মন্দ সংস্রব, বৈরী প্রভাব ইত্যাদির ফলে ধীরে ধীরে পবিত্র গোলাপ ফুলটি নষ্ট হতে থাকে। একসময় তার সুঘ্রাণ বিদূরিত হয়ে যায়। একটি সত্য কথা সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টি দুর্নীতি, অপরাধ, অন্যায়, অবিচার, জুলম, নির্যাতন ইত্যাদি করে না। অথচ মানুষকেই সবচেয়ে বেশি বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বাস, দক্ষতা, ন্যায়-অন্যায় চেনার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
দুর্নীতির সংজ্ঞা : দুর্নীতি হলো কুনীতি, কুরীতি, ন্যায় ও ধর্মবিরুদ্ধ আচরণ। পরিভাষায় দুর্নীতি বলা হয়—অবৈধ পন্থার ব্যবহার, অবৈধ পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করে বিশেষ স্বার্থ উদ্ধার অথবা অন্যের অধিকার হরণ কিংবা কোনো নাগরিক বা রাষ্ট্রের প্রতি অবিচার করা এবং স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়ে নাগরিক অথবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা। কেউ কেউ বলেন, দুর্নীতি হলো অসততা, অবৈধ আচরণ, বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে আসীন ব্যক্তিদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ইত্যাদি।
সাধারণত ঘুষ, বল প্রয়োগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যক্তিবিশেষকে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা অর্জনের নাম দুর্নীতি।
ইসলামের দৃষ্টিতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সুদ, ঘুষ, জুয়া তথা যেকোনো হারাম পন্থা অবলম্বন, ক্ষমতা ও পেশিশক্তির অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতারণা, আইনের অসৎ ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল এবং দেশ, জাতি ও সাধারণ নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ হরণ করার নাম দুর্নীতি।
দুর্নীতি কিভাবে বিস্তৃত হয় : দুর্নীতি নানাভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। যেমন—প্রভুত্বের মনোভাব, পশুস্বভাব, হিংস্রতা, অহংকার, প্রশংসা ও গৌরবের মোহ, সত্যের বিরোধিতা ও চিরস্থায়িত্বের বাসনা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের চরিত্রবিধ্বংসী স্বভাব। এগুলোই দুর্নীতির জন্ম দেয়। যদি বিকৃত স্বভাব ও কুরুচিপূর্ণ মনোভাব এবং আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায়, উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণ, অশালীন কথাবার্তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চালু হয়, তবে সে সমাজ নৈতিকতাবিবর্জিত হতে বাধ্য। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ, লজ্জা-শরম, স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার পরিবর্তে বেয়াদবি, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ব্যাপক হারে চালু হয়।
দুর্নীতি দমনে ইসলাম : ইসলাম দুর্নীতিকে আদৌ পছন্দ করে না। তাই দুর্নীতি দমনে ইসলাম নানাবিধ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম সর্বপ্রকার দুর্নীতির অপকারিতা ও কুফল বর্ণনা করেছে। অতঃপর তা থেকে বাঁচার জোর তাগিদ প্রদান করেছে এবং শাস্তির বিধান নিশ্চিত করেছে।
শাস্তির বিধান : দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে ইসলাম শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। যেমন—সন্ত্রাস ও ডাকাতির শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদগুলো বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা : আল মায়েদা, আয়াত : ৩৩)
আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করা : আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করার দ্বারা অপরাধ দমন করা যায়। তাকে অবহিত করতে হবে যে এই জগৎই শেষ কথা নয়। এখানে মানুষের চর্মচোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখিরাতে আল্লাহর দরবারে সব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে অন্যায়, দুর্নীতি, অসদাচরণ ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার যথাযথ জবাবদিহি করতে হবে এবং পরিণামে জাহান্নামের বীভৎস আজাবের সম্মুখীন হতে হবে। যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা শুধু অশ্লীল বিষয়গুলো হারাম করেছেন, যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং তিনি হারাম করেছেন গোনাহ, অন্যায়-অত্যাচার আর আল্লাহর সঙ্গে এমন বস্তু অংশীদার করা, তিনি যার কোনো সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩৩)
হালাল-হারাম সম্পর্কে অবগত করা : দুর্নীতি দমন বা সর্বপ্রকার অপরাধ দমনের মূলনীতি হিসেবে ইসলাম হালাল-হারাম তথা পবিত্র-অপবিত্রর পার্থক্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে। বৈধ ও অবৈধের প্রভেদ পরিষ্কার করেছে। যা স্রষ্টার দৃষ্টিতে পবিত্র, তা হালাল ও বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর যা অপবিত্র, তা হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হালালের কল্যাণ ও উপকারিতা এবং হারামের অপকারিতা ও ক্ষতি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী : ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
পার্থিব শাস্তির বিধান : দুর্নীতি দমনে আল্লাহর ভয়, আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি ইসলাম দুনিয়াবি শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা বিলম্বহীন ও নিরপেক্ষভাবে কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলাম কোনো দুর্নীতিবাজ কিংবা খুনি ও অপরাধীর শাস্তি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রাখেনি। যাতে অপরাধীরা এই সুযোগে বেঁচে যেতে সক্ষম না হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দেব।’
পরকালে পুরস্কারের ঘোষণা : সততা ও হালাল জীবনযাপনের ফলে ইহকালীন ও পরকালীন পুরস্কারের ঘোষণার মাধ্যমেও ইসলাম দুর্নীতি দমনের পদক্ষেপ নিয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হারাম সম্পদ দ্বারা যে শরীর গঠিত হয়, তা জাহান্নামে জ্বলবে।’
নাগরিক সচেতনতা : নাগরিক সচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেও দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসলাম। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় (পাপাচার, দুর্নীতি) হতে দেখে, সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দ্বারা রুখে দেয়। তা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দ্বারা তা প্রতিহত করে। আর তা-ও না পারলে সে যেন ওই অপকর্মকে হৃদয় দ্বারা বন্ধ করার পরিকল্পনা করে, এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’ (মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪৩৬)

কোন মন্তব্য নেই