আমরা ৭ লাখ মানুষ বলছি। আমরা নদীভাঙা, ছিন্নমূল, বাস্তুচ্যূত, অসহায়, ঠিকানাহীন মানুষ বলছি। হ্যাঁ, আমরা আমাদের অধিকারের কথাই বলতে চাচ্ছি। লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সাংসদ, শ্রদ্ধাভাজন মেজর (অব.) আবদুল মান্নান- আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, মেঘনার অব্যাহত ভাঙন তামাশায় যুগ যুগ ধরে আপনার সংসদীয় আসনটি দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। নদীর অস্বাভাবিক আচরণে প্রতিনিয়ত নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে মানুষের সহায়-সম্বল, তিলে তিলে গড়া মানুষের স্বপ্নের সম্পত্তি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, নদীভাঙা মানুষগুলো কতো কষ্টে, কতো বেদনাময় সময় পার করছে। তবে হ্যাঁ, যাদের দৃষ্টি গভীর, তারাই কেবল মানুষগুলোর কষ্ট গভীরভাবে বুঝতে পারছে।
যে মানুষটির ধন-সম্পদের ছিল না কোন অভাব, ছিল বিশাল অট্টালিকা। সে মানুষটি আজ পথের ভিখারি! মানুষ কোন সমস্যায় পড়ে যদি সম্পদ হারায়, তখন মানুষ নিজেকে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দিতে পারে। কিন্তু কোন দোষ ছাড়া, অপরাধ ছাড়া নিজের কষ্টে গড়া সম্বল নিমিষেই নদীর গহীন তলদেশে বিলীন হতে দেখে নিশ্চয়ই নিজকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কষ্টের। যে বেদনা ওই মানুষটি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ হয়তো সেভাবে বুঝবেন না।
লেখালেখির নেশা থেকে নদীভাঙন কবলিত ১৭ কিলোমিটার তটরেখার মেঘনার কূলে কূলে আমি হেঁটেছি। অসংখ্য ছবি ক্যামেরাবন্দি করে ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে দিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত জার্নালে আজও আমার তোলা নদী ভাঙনের বেশকিছু এবং একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস সংরক্ষিত আছে।
তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মিশেছি ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের জীবনের সাথে। তাদের কষ্ট, দুঃখগুলো যেন আমার জীবনে গেঁথে আছে। এসব মানুষের পক্ষে দু’মুঠো ভাত ঠিকমতো পেটে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হচ্ছে। কখনো কখনো দেখেছি, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে, তখনো কারো কারো চুলায় এখনো আগুন জ্বলেনি। আবার কখনো দেখেছি, নদীর পাড়ে বসে বসে কেউ ভাঙনে হারানো জমি-জমার সীমানা টানার চেষ্টা করছেন। গালে হাত রেখে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে বসে এসব মানুষ কষ্টগুলোকে বুকে নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। খবরের সংগ্রাহক বলে মানুষ ব্যস্ত হয়ে যান তাদের হারানো সম্পদের বিবরণ দিতে। উদ্দেশ্য, ভাঙন থেকে রক্ষায় সরকারের কাছে কষ্টগুলো পৌঁছানো। এসব মানুষ আশায় বুক বাঁধেন শেষ সময়েও হয়তো বাঁধ নির্মাণ হবে, তাদের সম্পদটুকু নদীর হানা থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু আশায় আশায় বুক বাঁধা মানুষের কাছে এসব কিছুই দিন দিন চরম ধোঁয়াশায় রূপ নিয়েছে।
মাননীয় সাংসদ, আমি জানি আপনি নদীভাঙা মানুষের কষ্ট বোঝেন। যখন ছোট ছিলাম, তখন জেনেছি- আপনিও বাঁধ নির্মাণ এবং এসব মানুষের কষ্টের সঙ্গি হিসেবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। আপনি তখন রাষ্ট্র পরিচালনার কোন দায়িত্বেও ছিলেন না। মানুষের মনে আপনি চিরদিনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। মানুষের মুখে আজও আপনার অবদানের কথা শুনতে পাই। তাই আমিও আশা ছাড়িনি। আপনার দ্বারা কিছু হবে, সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। কিন্তু দিন দিন আমিও চরম চিন্তার কোলে ঢলে পড়ছি।
এমপি সাহেব, দেখুন একবার, নদী ভাঙে ৩৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। অথচ নির্মাণ করা হয়েছিল সাড়ে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। রামগতিতে সাড়ে ৩ কিলোমিটার আর কমলনগরে মাত্র ১ কিলোমিটার। রামগতির বাঁধ সেনাবাহিনী দিয়ে নির্মাণ করা হলেও কমলনগরের বেলায় সেটি নির্মাণ করা হয়েছে একটি দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। যার কারণে এ বাঁধ এখন পর্য়ন্ত ৯ বার ধসে পড়েছে। বাঁধ ছাড়িয়ে তীরে তীব্র ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষার কারণে এ ভাঙন আরও তীব্র হতে চলেছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব সমস্যার কথা বলতে গেলে মানুষকে দোষারোপ করা হয়। বিনয়ের সাথে মানববন্ধন করে সরকারের কাছে দাবি জানাতে গেলে মানববন্ধনকে তছনছ করে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ এ নিয়ে লিখলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, নদী ভাঙন নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা লেখালেখি করায় তাদের পড়তে হয়েছিল কঠিন পরিস্থির মুখে। সব বাঁধা পেরিয়ে সবাই এখন সোচ্চার। দাবি তুলছেন ভিটে-মাটি রক্ষার।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সম্প্রতি আপনার আসনটি রক্ষায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এবং নদীর পাড়ে এক অভিনব মানববন্ধনের আয়োজন করে ‘কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন। মানববন্ধন থেকে হাজার হাজার মানুষ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারের কাছে বেঁচে থাকার আকুতি জানিয়েছেন। বাসস্থানের অধিকার তো মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। এর জন্য মানুষকে আবার আন্দোলন করতে হবে কেন? কিন্তু কেন করে, সেটা তো সবারই বোঝার কথা। পায় না বলেই এ আন্দোলনের প্রশ্ন আসে। নদী ভেঙে যেসব মানুষ নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবন পার করছে, তাদের চেয়েও ভিনদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গারা অ