পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতা কল্পনা না বাস্তবিক!

0
249

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতা কল্পনা না বাস্তবিক!
জিবলু রহমান

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ‘আসমানী’ কবিতাটি ১৯৪৬ সালে রচনা করেন। কবিতাটি ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত কবির ‘এক পয়সার বাঁশী’ কাব্য গ্রন্থে স্থান পায়। পরবর্তী সময় কবিতাটি স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কবিতাটি ছিল এরূপ-

আসমানী
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,
সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।
পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।

আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,
কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?

জসীমউদ্দীনের অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’ কবিতা কী কল্পনা নির্ভর না বাস্তবিক। তথ্যের সত্যতা হলো বাস্তবিক। আর সেই আসমানী মারা গিয়েছিলেন ১৮ আগস্ট ২০১২ তারিখে। ভাররাত তিনটার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি ছয় মেয়ে ও চার ছেলে রেখে যান। আসমানীকে পারিবারিক কবরস্থানে স্বামী হাসেমউদ্দিন ম-লের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
২০১২ সালের ২৩ জুন বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হলে আসমানীকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে ২৭ জুলাই তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ৫ আগস্ট তাঁকে রসুলপুরে নিয়ে আসা হয়।
আসমানী বেগমের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। আসমানীর ৯ বছর বয়সের সময় জসীমউদ্দীন তার গ্রামে গিয়েছিলেন। রসুলপুর আসমানীর শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী ভানুর ডাঙ্গী গ্রামে, আসমানীর বাবা আরমান মল্লিক। বড়ো আদর করে আরমান মল্লিক মেয়ের নাম রেখেছিলেন আসমানী। মাত্র ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় আসমানীর। বর রসুলপুর গ্রামের হাসেম ম-ল, সতীনের সংসার। আসমানীকে ঘরে আনার আগেই আরেকটি বিয়ে করেছিলেন হাসেম ম-ল।
মূলত জসীমউদ্দীনের ভাই সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদের শ্বশুর বাড়ি ছিল আজকের ফরিদপুর সদরের ইষান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে। সেখানে একবার বেড়াতে গিয়ে এই আসমানীর দেখা পান জসীমউদ্দীন। কবি জসীমউদ্দীনের ‘জীবন কথা’ বইয়ের প্রথম সংস্করণে এই তথ্যটি ছিল। তবে ফরিদপুরের একজন জেলাপ্রশাসক জালাল আহমদে উদ্যোগ নিয়ে এই আসমানীকে খুঁজে বের করেন।
জসিমউদ্দীন রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়িতে অন্ন-বস্ত্র ও জীর্ণশীর্ণ বসতবাড়িতে আসমানীকে দেখতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাংলার চিরায়ত নারী দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষুধা-যন্ত্রণার সাথী হওয়ার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মরহুম আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আসমানীর মৃত্যুর পরও তিনি অমলিন। কবির সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যিনি অমরতা লাভ করেছেন, বাস্তব জীবনে তাঁর অস্তিত্ব আমাদের আলোড়িত করেছে। তাঁকে কবিতার মধ্য দিয়ে কবি আমাদের আপনজন করে তুলেছেন। আসমানী আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া পল্লীকবির সাহিত্য কর্মে।’
আসমানী আজও বেঁচে আছেন, পল্লীকবির কবিতার আসমানী বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। ২০০৩ সালে পত্রপত্রিকায় ‘আসমানীকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশব্যাপী জসীমউদ্দীনের সৃষ্টি বাস্তব চরিত্র আসমানীকে নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এর কয়েক বছর পর এনজিও সংস্থা প্রশিকা একটি ছোট্ট আধুনিক টালির ঘর নির্মাণ করে দেয় আসমানীকে। তারপর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসমানীকে দেখতে রসুলপুরে আসতে শুরু করে।
জসীমউদ্দীনের চিন্তার সেই আসামীদের এখন দেশের সব জায়গায়ই মিলে। তাদের কেউ বিভিন্ন বাসায় গৃহস্থালির কাজ করেন, বসবাস জরাজীর্ণ ঘরে, বৃষ্টি আসলে আশ্রয় নিতে হয় অন্যের ঘরে। সচেতনতার অভাবে জন্ম নেওয়া অনেক ছেলেমেয়ের সংসারে অভাব-অনটন সবসময় লেগেই থাকে। অনেকের রান্নাঘরে নেই বেড়া, টিন ছিদ্র। থাকে দুইটা রুম। অনেকে থাকেন পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া একটি ছোট্ট ঘরে। অনেক স্থানের বৃদ্ধরা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের খুশি আর চামচামি না করলে কোনো সরকারি ভাতার টাকা পান না। একটি ঘর পান না। কেউ ভাতার দিবে বলে উৎকোচ নিলেও তার কার্যকারিতা নেই। কারণ সবতো হয় ম্যানেজে।
‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’র আওতায় বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা পেতে গেলে তাদের উচু দরের তদবির করতে হয়। সেই তদবিরে তারা কুলিয়ে উঠতে পারে না, তাই তাদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না।
স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তখন বলেন, ‘নতুন ভাতার কার্ড পেলে সহযোগিতা করা হবে।’ উপজেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার সাথে যোগাযোগ করলে তাদের ভাতার ব্যবস্থা করে দিবো।’ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেন, ‘হতদরিদ্রদের ঘর আসেনি। নতুন প্রকল্প আসলে সহযোগিতা করা হবে।’
এগুলোই আসমানীদের প্রকৃত চিত্র, পরিবারের চিত্র। আর চিকিৎসার সেবার বিষয়টি আরো মারাত্মক। এসব অসহায় মানুষদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই নেই। সংবাদপত্রের কেউ যখন তাদের কাছে যান তখন আক্ষেপের সূরে বলেন-‘কেউ কোনো রকম সাহায্য সহযোগীতা করে না। খুবই কষ্ট হচ্ছে। এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো।’

কোন মন্তব্য নেই