এম হায়দার চৌধুরী, শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে::
বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, নিত্যনতুন আবিষ্কার ও ক্রমবিকাশের কারনে মানুষ বিদ্যুৎ চালিত জীবনোপকরনের উপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই, বলা যায় ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও ধরে রাখার কোন উপায় নেই। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্রই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। শায়েস্তাগঞ্জসহ গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে আপামর জনসাধারণের কাছে ঐতিহ্যের ধারক “হারিকেন” ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। হারিকেন নামটি শুনলেই বোঝা যায় এটি একটি আলো প্রাপ্তির যন্ত্র। বর্তমান সময়ের নতুন প্রজন্ম শুধু বইপত্রে হারিকেন নামটি পড়লেও সরাসরি এটির সাথে পরিচয় নাও থাকতে পারে।
একসময় শায়েস্তাগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাতের অন্ধকার নেমে আসার আগেই হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হতো আলো প্রাপ্তির প্রয়োজনে। এছাড়া কুপি বাতিরও ব্যবহার ছিল অহরহ। হারিকেন ও কুপিবাতি উভয় প্রকারের যন্ত্র জ্বালানোর মূল উপাদান ছিল কেরোসিন। কেরোসিনে সুতার তৈরি সলতে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে উৎপাদন করা হতো আলো। হারিকেনের সলতের আগুনের চতুর্দিকে কাঁচের তৈরি চিমনি দিয়ে ঘিরে রাখা হতো উজ্জ্বল আলো প্রাপ্তির জন্য। কুপি বাতির সলতের আগুন উন্মুক্ত থাকতো, যাতে করে এর থেকে আলো এবং আগুন দুটোই পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে হারিকেনের মৃদু আলো, এখনকার ডিম লাইটের বিকল্প ছিল।
এছাড়াও রাতের বেলা বহিরঙ্গনে ব্যবহারের জন্য অন্যতম ও অতি প্রয়োজনীয় আলোর উৎস ছিল টর্চ লাইট। এ টর্চ লাইটের মূল চালিকা শক্তি ছিল ড্রাইসেল বা ব্যাটারি। ওই ব্যাটারিগুলো রিচার্জেবল ছিল না, ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে ফেলে দেয়া হতো। এরপর নতুন ব্যাটারী দিয়ে আবার টর্চ লাইট সচল করা হতো। তখনকার সময়ে ওই টর্চ লাইটগুলো এখনকার তুলনায় ব্যয়বহুল ছিল। ওই টর্চ লাইটগলোও হারিয়ে গেছে, তা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পুরাতন সংগ্রহশালায় পড়ে আছে। তত্কালীন সময়ে মেয়ের বিয়েতে সকল জিনিসপত্রের সাথে হারিকেন ছিল অন্যতম জরুরি জিনিস। কেউ কেউ আবার আদর করে জামাইকে টর্চ লাইট উপহার দিতেন। কালের বিবর্তনে ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন ও টর্চ লাইট দুটোই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে জনসাধারণের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, শায়েস্তাগঞ্জের মিঠুন নামের একজন ক্ষোভের সাথে বলেন, হারিকেন ও কুপি বাতিই ভালো ছিল, নিজের ইচ্ছায় ব্যবহার করা যেতো। এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করি ঠিকই, তবে এতে ভোগান্তিও কম নয়। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বিকল্প আলোর ব্যবহার করতে হয়, তখনই হারিকেনের কথা মনে পড়ে। রোকেয়া নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে অনেক কিছুই মনে পড়ে। যেমন, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের প্রাণ জারী সারি গান, পুঁথি পাঠ, পালা গান ও যাত্রাপালা ইত্যাদি। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি, পালকি ও হারিকেন। হারিকেনের অবদান বলাই বাহুল্য, একসময় হারিকেন মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। হারিকেন ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাপন কল্পনার বাইরে ছিল। এখন সেই হারিকেনের আর কদর নাই। তাই, বলতে হয়
হারিয়ে যাচ্ছে হারিকেন, বৃদ্ধি পাচ্ছে এলইডি লাইট ও বৈদ্যুতিক ফ্যান।