বাংলা বছরের উৎপত্তি ও উদযাপন
এমএইছ চৌধুরী, জুনাইদ শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে :: আজ পহেলা বৈশাখ, বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী বাংলাবর্ষ বরণের দিন, পহেলা বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকা বছরের প্রারম্ভিক মাস, বৈশাখ মাসের ১ তারিখ, বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী লোকজন এ দিনটিকে উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকে। সেদিক থেকে এই দিনটি বাংলাভাষী মানুষের একটি অন্যতম লোকজউৎসবের দিন।
বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত ১৪ই এপ্রিল তারিখে আমরা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকি। এই দিনটি বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত একটি বিশেষ সরকারি ছুটির দিন। বাঙালী ব্যবসায়ীরা এই দিনকে “হালখাতা” হিসেবে পালন করে থাকে। অর্থাৎ পুরনো বছরের সকল হিসাবপত্র চুকিয়ে নতুনভাবে ব্যবসার হিসাব আরম্ভ করা উপলক্ষ এ দিনটিকে বরণ করে নেয়।
মূলত হালখাতা হচ্ছে বিগত বছরের হিসাব চুকিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনে ব্যবসায়ের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রামে, শহরে সবখানেই এ প্রক্রিয়ায় পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলা হয়। হালখাতা উপলক্ষে দোকানদাররা তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই হালখাতা প্রথাটি নিয়মিত পালন করেন বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসয়ী এবং স্বর্ণালঙ্কার বিক্রেতারা।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশে পালিত বাংলা বর্ষবরণ উৎসব আনন্দ শোভাযাত্রা, হস্তশিল্প ও কৃষি সমগ্রী মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”। নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কর্তৃক আয়োজিত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসবকে ২০১৬ সালে, “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
বাংলা বর্ষপঞ্জীকার সাথে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক অসঙ্গতি রয়েছে। হিজরী তারিখ গণনায় নতুন দিনের শুরু হয় সূর্য অস্তমিত হয়ে রাতের সূচনায় আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুরু হয় ইউটিসি ০০:০০ অনুযায়ী অর্থাৎ মধ্য রাতে। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় হতে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী কর্তৃক চালুকৃত নিয়মে রাত ১২.০০টার পর বাংলা দিবস গণনা শুরুর হয়। এখন বাংলা নতুন বছরের সূচনায়, নববর্ষ পালন উৎসব একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলা বছর উৎপত্তিকালে এরকম ছিলনা। তখনকার দিনে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখকে ষড়ঋতুর একটি ঋতু হিসেবে উৎসব পালন করা হত। সে সময় এর মূল তাৎপর্য ছিল লোকজনের কৃষি ভিত্তিক স্বাবলম্বীতা অর্জন।
মোঘল শাসনামলে সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসরণ করে কৃষকদের নিকট থেকে কৃষি পণ্যের উপর আরোপিত খাজনা আদায় করতেন। হিজরী সন চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি পণ্য উৎপাদন বিপনন ইত্যাদির সাথে মিলত না। এতে করে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। যা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। অনেক সময় খাজনা পরিশোধ করার জন্য তাদের অতি প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য, গরু, ছাগল ইত্যাদি বিক্রি করতে হতো।
এভাবে খাজনা আদায়কালে প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের লক্ষ্যে মোঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা সন প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৫৮৪ খ্রি’র ১০ মার্চ থেকে সম্রাট আকবরের আদেশ অনুযায়ী বাংলা বছর গণনা শুরু হয়েছিল। পরবর্তিতে এই বাংলা বছর গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের দিন থেকে অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে।
সেদিন থেকে বাংলা বছরের উৎপত্তি পরিচিতি ও ব্যবহার শুরু হয়। মোঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গোড়াপত্তন হয়েছিল। সে সময়ে প্রজাদের চৈত্র মাস সমাপ্তির পূর্বেই যাবতীয় খাজনা বাধ্যতামূলক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিন ভুস্বামী এবং রাজ্যের মালিকগণ যাবতীয় খাজনা হাতে পেয়ে খুসী হয়ে নিজ নিজ শাসনাধীন প্রজাদের বিশেষ ভাবে তৈরী মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। ওই সময়ই বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। তখনকার দিনে পালন করা উৎসবগুলোই এখন বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হিসেবে একটি ঐতিহ্যগত সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে নববর্ষ উৎসব পালনের সঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক লক্ষনীয়। এখন গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে শহরের মানুষও কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন বছর পালনের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নববর্ষ উপলক্ষে ক্রয় করা বিশেষ নতুন জামাকাপড় পরে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে অথবা কোলাহল মুক্ত স্থানে, পর্কে বেড়াতে যায়। এ উপলক্ষে বাড়িঘর সাজানোসহ বিশেষ বিশেষ খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। বাংলা বছর বরণ উপলক্ষে গ্রামের মানুষরা মিলে এলাকার খোলা মাঠে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। ওই মেলাতে কুটির শিল্পজাত সামগ্রী বিশেষ করে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরীকৃত সমগ্রীর প্রদর্শনী ও বিপণনের আয়োজনও থাকে। পাশাপাশি নানান রকম মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্য, গ্রাম্য পিঠা পুলির প্রদর্শনী ও বিক্রীর আয়োজন উল্লেখযোগ্য।
এদিকে শহরাঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ, ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া। শহরবাসীরা সারাবছর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। এই দিনকে কেন্দ্র করে পুরনো সংস্কৃতির অংশ হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি এক সময় জনপ্রিয় ও প্রচলিত খেলা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের কুস্তি খেলার সবচেয়ে বড় আসরটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত আছে এবং থাকবে।