বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার

0
41

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’আমি চাইছিলাম তারা আগে আঘাত করুক’

ডেভিড ফ্রস্ট :নতুন একটা জাতির জন্ম হয়েছে। আর আজ সেই নয়া জাতির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে কথা বলবেন।
এটা গত কয়েক মাসের রক্তপাত নিয়ে তার গল্প, যে রক্তপাত থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। জয় বাংলা! যে রাতে অচিরেই হামলা চালাবে পশ্চিম পাকিস্তান, সে রাতে আপনি বাসায়ই ছিলেন। আমার ধারণা, রাত ৮টায় ফোনে আপনাকে সতর্কও করা হয়েছিল যে আর্মি পথে রয়েছে। তার পরও কেন আপনি থেকে যাওয়ার এবং গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, এখানে একটা চমৎকার গল্প আছে। ওই সন্ধ্যায় কমান্ডোরা আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছিল, বাড়ি থেকে বেরোলেই ওরা আমাকে মেরে ফেলত। তারপর আমার লোকজনের নাম করে বলত, বাংলাদেশের চরমপন্থীদের হাতে মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছে। সারা দুনিয়াকে বলত, আমরা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলাম; কিন্তু চরমপন্থীরা মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, এখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়ার আর কোনো বিকল্প নেই। এবং তারা ব্যবস্থা নিত। এটাই ছিল তাদের অভিসন্ধি।
তাই ভাবলাম, তার চেয়ে বরং আমার মরাই ভালো, অন্তত আমার লোকেরা তো বাঁচবে, যারা আমাকে এত ভালোবাসে।

ফ্রস্ট : আপনি কলকাতায় চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব : যেতে চাইলে যেকোনো জায়গায়ই যেতে পারতাম। কিন্তু আমার লোকদের ছেড়ে আমি কী করে যাই? আমি তো জাতির নেতা।

ফ্রস্ট : অবশ্যই আপনি ঠিক। আর এটাই গত ৯ মাস আপনাকে এমন এক প্রতীকে পরিণত করেছে, যার ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারে। তারা তো আপনাকে এখন প্রায় ঈশ্বরই মনে করে।
শেখ মুজিব : আমি তা বলব না, আমি বরং বলব তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি তাদের ভালোবাসি, তাই তাদের জীবন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু ওই জানোয়ারেরা আমাকে গ্রেপ্তার করেছে, আমার বাড়ি ধ্বংস করছে, আমার গ্রামের বাড়ি ধ্বংস করছে, যে বাড়িতে আমার বুড়ো মা-বাবা থাকতেন। আমার বাবার বয়স ৯০ বছর, মার ৮০। তাঁরা আমার গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার এই পূর্বপুরুষের ভিটে। তারা সেখানে পর্যন্ত আর্মি পাঠিয়েছে, আমার মা-বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তাঁদের সামনে ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁদের কোনো আশ্রয় ছিল না।

ফ্রস্ট : তারা ঠিক কিভাবে আপনাকে গ্রেপ্তার করল? তখন রাত দেড়টা, তাই না? কী ঘটল?
শেখ মুজিব : প্রথমে তারা মেশিনগানে আমার বাড়ি ঝাঁঝরা করে দিল।

ফ্রস্ট : তারা যখন এলো তখন আপনি কোথায়?
শেখ মুজিব : আমি শোয়ার ঘরে ছিলাম- এটাই আমার শোয়ার ঘর। ওই দিক থেকে তারা মেশিনগান চালানো শুরু করল। এদিকেও কিছু মেশিনগান ছিল। আর ওই দিক থেকে তারা জানালা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল।

ফ্রস্ট : এই সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব : সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি পরিবারের সঙ্গেই ছিলাম। একটা গুলি শোয়ার ঘরে ঢুকল। আমার ছয় বছরের বাচ্চা বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার স্ত্রী এখানেই ছিল।

ফ্রস্ট : পাকিস্তানি ফৌজেরা কোন দিক দিয়ে ঢুকল?
শেখ মুজিব : সব দিক দিয়ে। তারা জানালা দিয়ে গুলি শুরু করল। তখন দুই বাচ্চা নিয়ে স্ত্রীকে এখানেই বসতে বললাম। তারপর বাইরে গেলাম।

ফ্রস্ট : তিনি কী বললেন?
শেখ মুজিব : একটা শব্দও [উচ্চারণ করলেন] না। তাকে চুম্বন করলাম, বিদায় চুম্বন। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম, ওদের গুলি থামাতে বললাম, ‘গুলি বন্ধ করো। এই যে আমি এখানে। কেন গুলি চালাচ্ছ, কী জন্য?’ তখন তারা, ফৌজিরা, বেয়োনেট দিয়ে চার্জ করতে চারদিক থেকে ছুটে এলো। একজন অফিসার ছিলেন, তিনি তখন এভাবে আমাকে ধরলেন, বললেন, ‘ওকে মেরো না। ‘

ফ্রস্ট : শুধু একজন অফিসার ওদের থামাল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ। তখন তারা টেনেহিঁচড়ে আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলল, পেছন থেকে তারা আমার পায়ে আঘাত করতে লাগল, এখানে-ওখানে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ধাক্কাতে লাগল। অফিসারটি আমাকে ধরে ছিল, তার পরও ওরা আমাকে ধাক্কাচ্ছিল আর নিচের দিকে টানছিল। ‘টানাটানি করো না,’ ওদের বললাম। ‘দাঁড়াও, স্ত্রীর কাছ থেকে পাইপ আর তামাকটা অন্তত আনতে দাও। ‘ আবার ওপরে এলাম। দেখি দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার স্ত্রী দঁাঁড়িয়ে আছে। তারা পাইপ আর একটা ছোট স্যুটকেস নিল…তারা এখান থেকে আমাকে নিয়ে গেল।

ফ্রস্ট : আপনি যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কখনো এই বাড়ি দেখতে পাবেন?
শেখ মুজিব : ভাবিনি। ভেবেছিলাম, এই শেষ। কিন্তু একজন নেতা হিসেবে মাথা উঁচু করে যদি মরতে পারি, তাহলে তারা অন্তত লজ্জিত হবে না। কিন্তু আমি যদি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে আমার জাতি, আমার দেশের জনগণ দুনিয়ার কাছে [মুখ] দেখাতে পারবে না। তার চেয়ে জনগণের মর্যাদা সমুন্নত রেখে মরাই বরং ভালো।

ফ্রস্ট : আপনি একবার বলেছিলেন, ‘মরতে প্রস্তুত এমন কাউকে তুমি মারতে পারো না’ তাই না?
শেখ মুজিব : আমি তাদের বলেছিলাম মরতে প্রস্তুত এমন কোনো ব্যক্তিকে কেউ মারতে পারে না। শারীরিকভাবে একজন লোককে তুমি মারতে পারো, কিন্তু মানুষের আত্মাকে কী মারতে পারো? পারো না- এটাই আমার বিশ্বাস। আমি মুসলমান আর একজন মুসলমান একবারই মরে, দুইবার না।

ফ্রস্ট : পাকিস্তানিরা কী আপনার বাড়ি থেকে সব কিছু লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমার পুরো বাড়ি। এমনকি বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়চোপড়- সব কিছু। তারা সব কিছুই নিয়ে গিয়েছিল। দেখতেই পাচ্ছেন, কিছুই নেই…আলমারি, আসবাবপত্র, কাপড়, বাচ্চাদের পোশাক নেওয়ায় কিছু মনে করিনি, কিন্তু ওরা আমার জীবনের ইতিহাসটা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ডায়েরি ছিল। চমৎকার একটা লাইব্রেরি ছিল। মূল্যবান কয়েকটা দলিলসহ প্রতিটি বই তারা নিয়ে গেছে।

ফ্রস্ট : আপনার বিচারের কী হলো?
শেখ মুজিব : পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা আর সব বেসামরিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে তারা একটা সামরিক আদালত গঠন করল।

ফ্রস্ট : আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল তারা?
শেখ মুজিব : চক্রান্ত, পাকিস্তান সরকার ও সশস্ত্রব াহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাকে স্বাধীন করতে চাওয়া- কী নয়। ১২টা অভিযোগ, তার মধ্যে ছয়টার শাস্তি ফাঁসি।

ফ্রস্ট : আপনার আইনজীবী ছিল?
শেখ মুজিব : সরকার প্রথমে আইনজীবী দিয়েছিল। কিন্তু অবস্থা দেখে আমার মনে হলো, ‘আত্মপক্ষ সমর্থন করে লাভ নেই। এটা একটা তামাশার বিচার। এটা একটা প্রহসন। ‘ তখন আমি আদালতে দঁাঁড়িয়ে বললাম, ‘বিচারক মহোদয়, বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের দয়া করে চলে যেতে বলুন। কারণ আপনি জানেন, এটা একটা গোপন বিচার (ক্যামেরা ট্রায়াল)। আমি কোনো সামরিক ব্যক্তি না, একজন বেসামরিক মানুষ অথচ তারা আমাকে সামরিক আদালতে বিচার করছে। জনাব ইয়াহিয়া খান শুধু রাষ্ট্রপতিই নন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও। তিনিই অনুমোদনকারী। তিনিই আবার এই আদালতের আহ্বায়ক। ‘

ফ্রস্ট : তো, আপনি বলতে চাইছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত যা ইচ্ছা তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?
শেখ মুজিব : তিনি যা ইচ্ছা তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ফ্রস্ট : আপনি কী আদালতে যাওয়া অব্যাহত রাখলেন, নাকি বন্ধ করে দিলেন?
শেখ মুজিব : আমি যেতে বাধ্য। আমি তো কয়েদি।
ফ্রস্ট : ধরে নিচ্ছি বিষয়টা আপনার ইচ্ছাধীন ছিল না। তারা কি কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল?
শেখ মুজিব : ৪ ডিসেম্বরের বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রায় বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য জনাব ইয়াহিয়া খান তাঁর সব বিচারক অর্থাৎ লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ারদের রাওয়াপিণ্ডিতে ডাকলেন। সেখানে তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নিল।

ফ্রস্ট : আর সত্যি সত্যি আপনি আবিষ্কার করলেন যে পাশের সেলে তারা একটা কবর খুঁড়ছে।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমি দেখলাম, আমার সেলের কাছেই তারা একটা কবর খুঁড়ল।

ফ্রস্ট : আপনি জানতেন যে তারা এটা করছে?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তখন আমি বললাম, ‘বুঝছি, এটাই হয়তো আমার কবর। ঠিক আছে, আমি প্রস্তুত। ‘

ফ্রস্ট : তারা কি বলেছে যে ‘হ্যাঁ, এইটা তোমার কবর?’
শেখ মুজিব : না, তারা সেটা বলেনি।
ফ্রস্ট : তারা কী বলছে?
শেখ মুজিব : তারা বলছে, ‘না, না, না, না, বোমাবর্ষণ হলে যেন আশ্রয় নিতে পারি, তার জন্য একটা ব্যবস্থা করছি। ‘
ফ্রস্ট : তখন আপনি কী ভাবতেন?
শেখ মুজিব : ৯ মাসজুড়েই আমি জানতাম, যেকোনো দিন আমি মারা যেতে পারি।

ফ্রস্ট : আপনি যখন তাদের কবর খুঁড়তে দেখলেন তখন আপনি প্রথমে কার কথা ভেবেছিলেন- দেশের কথা, নাকি স্ত্রী-সন্তানের কথা?
শেখ মুজিব : আমার দেশ, আমার জনগণের কথা ভেবেছিলাম, তারপর আমার পরিবার। আমি আমার জনগণকে বেশি ভালোবাসি।

ফ্রস্ট : তো আপনাকে সেই কবর থেকে কে বাঁচাল?
শেখ মুজিব : আমার মনে হয় আল্লাহ। সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে বাঁচিয়েছে।

ফ্রস্ট : একপর্যায়ে কারারক্ষক কি আপনাকে সরিয়ে নিল? ইয়াহিয়া যখন হত্যা করার জন্য আপনাকে নিতে এলো, তখনই কি সে আপনাকে সরিয়ে ফেলল, যেমনটা এক বিবরণে আমি পড়েছি।
শেখ মুজিব : তারা একটা পরিস্থিতি তৈরি করে জেলখানায় কিছু কয়েদিকে জড়ো করল, যাতে খুব ভোরে আক্রমণ করে আমাকে হত্যা করতে পারে। আমার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা সম্ভবত আমাকে পছন্দ করত। হয়তো সে বুঝতে পেরেছিল, ইয়াহিয়ার দিন শেষ। রাত ৩টায় সে আমাকে জেল থেকে বের করে দুই দিন তার বাংলোয় কোনো সামরিক পাহারা ছাড়াই রাখল। দুই দিন পর সেখান থেকে সে আমাকে কলোনির আরেকটা পরিত্যক্ত এলাকায় নিয়ে গেল। সেখানে সে আমাকে ৪, ৫ বা ৬ দিন রাখল। কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ জানত না আমি কোথায়।

ফ্রস্ট : এমনকি মি. ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ও ইয়াহিয়া আবার আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সুপারিশ করেছেন। এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব : একদম ঠিক। আমাকে বলা মি. ভুট্টোর গল্পগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মি. ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা সমর্পণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করার সময় ইয়াহিয়া বলেছিল, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা না করে চরম ভুল করেছি। ‘

ফ্রস্ট : তিনি এ কথা বলেছেন?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, সে আরো বলেছে, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে দয়া করে ব্যাকডেট দিয়ে এখন তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার অনুমতি দিন। তারপর ক্ষমতা হস্তান্তর। ‘ কিন্তু ভুট্টো [তার অনুরোধ] প্রত্যাখ্যান করেছে।

ফ্রস্ট : ভুট্টো তাঁকে কী বলেছিলেন?
শেখ মুজিব : ভুট্টো বলেছিল, ‘আমি অনুমতি দিতে পারব না। কেননা এর পরিণতি হবে সাংঘাতিক। বাংলায় এক লাখ ২০ হাজার সামরিক ও বেসামরিক লোক আটক রয়েছে। তারা বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর [সমন্বয়ে গঠিত] মিত্রবাহিনীর হাতে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি আছে। এখন যদি আপনি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেন এবং ক্ষমতা নেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে একটা জানও আর পশ্চিম পাকিস্তানে আসবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তার প্রতিক্রিয়া হবে। ফলে আমার অবস্থানও হয়ে উঠবে অনিশ্চিত। ‘ সন্দেহ নেই, ভুট্টো সাহেবের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

ফ্রস্ট : আজকে যদি ইয়াহিয়া খানকে সামনে পান, তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিব : সে একটা দুর্বৃত্ত, আমি তার ছবিটা পর্যন্ত দেখতে চাই না। তার সৈন্যদের দিয়ে সে আমার বাংলাদেশের ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে।

ফ্রস্ট : আপনি কী করে জানেন যে সংখ্যাটা ৩০ লাখের মতো এত বেশি?
শেখ মুজিব : আমার ফেরার আগেই আমার লোকেরা তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। যেখানেই আমার ঘাঁটি আছে, সব জায়গা থেকেই খবর আসছে। আমরা এখনো চূড়ান্ত করতে পারিনি, এটা আরো বেশিও হতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবেই এটা ৩০ লাখের কম না।

ফ্রস্ট : এর দ্বারা তারা কী লাভ করতে চেয়েছিল?
শেখ মুজিব : এই দেশটাকে তারা উপনিবেশ করে রাখতে চেয়েছিল।

ফ্রস্ট : আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া খান একজন দুর্বল লোক, অন্যের দ্বারা চালিত হয়ে অশুভের দিকে ধাবিত হয়েছে; নাকি সে নিজেই একটা শয়তান?
শেখ মুজিব : সে নিজেই একটা শয়তান- তার বন্ধু, সহকর্মীরাই এ কথা বলছে। আপনি অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিতে পারেন না। সে একটা বিপজ্জনক লোক, ভণ্ড। সে যখন রাষ্ট্রপতি আর আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, তখন তার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি…

ফ্রস্ট : সে আপনাকে বিভ্রান্ত করেছে, তাই না?
শেখ মুজিব : সে আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমি জানতাম সে কী করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমিও আঘাত করার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। সেই আঘাতটা সে এখন পাইছে।

ফ্রস্ট : কিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন?
শেখ মুজিব : পাল্টা আঘাত। আর সেটা সে পাইছে।
ফ্রস্ট : ভুট্টো সম্পর্কে আপনার কী ধারণা এখন? আপনার কি মনে হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক দিন তিনি ঢাকা সফর করবেন? আলোচনা করতে আদৌ কি কখনো আসবেন তিনি?
শেখ মুজিব : জানি না, তবে বাস্তবতাটা তাকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশ এখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, তার বোঝা উচিত বাংলা তার ভূখণ্ড বলে চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। কারণ বাংলাদেশ তা না। আর বাস্তবতার খাতিরে তারা যদি এক পাকিস্তান দাবিও করে, তাহলে আপনি জানেন, আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানকে আমার ভূখণ্ড ধরে আমিই নিজেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি দাবি করতে পারি। তারা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে আমি দাবি করতে পারি যে আমার দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ, একটা বৈঠক ডেকে পুরো দেশটাকেই বাংলাদেশ ঘোষণা করতে পারি, তাদের বলতে পারি পশ্চিম পাকিস্তান আমার ভূখণ্ড। ভুট্টো, তুমি বেরিয়ে যাও, আমি গভর্নর নিয়োগ করছি। এটা আমার ভূখণ্ড, তুমি সরে যাও, নইলে পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নিতে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আমার সেনাবাহিনীকে পাঠাব। কিন্তু এসব ঝামেলা আমি করতে চাই না। ভূখণ্ডের প্রতি কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। ভুট্টো সাহেব তার পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে সুখে থাক। আমি আমার বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র।

ফ্রস্ট : নতুন একটা দেশের প্রথম সপ্তাহে কত কিছুই না আপনাকে করতে হবে। যেমন- একটা পতাকা আর জাতীয় সংগীতও নির্বাচন করেছেন আপনি।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, পতাকাটা অবশ্য অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে, খালি সামান্য একটা বদল করা হয়েছে। আর অনেক আগে থেকেই এটা আমাদের জাতীয় সংগীত, আমি খালি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলাম, সেই স্বীকৃতিটা এখন আমি দিয়েছি। আমার পতাকায় ছোট্ট একটা বদল আমি করছি, আমার পতাকায় বাংলাদেশের একটা মানচিত্র ছিল, কোনো দেশই তাদের পতাকায় তার ভূখণ্ডের মানচিত্র দিতে পারে না।

ফ্রস্ট : কেন পারে না?
শেখ মুজিব : দুনিয়ার কোথাও এমনটি হয়নি। পতাকায় আমার ভূখণ্ডের মানচিত্রটা আমরা রাখতে চাই না। আমি করেছি কী, ভূখণ্ডের মানচিত্রটা বাদ দিয়েছি; কিন্তু উদীয়মান সূর্যটা রেখে দিয়েছি, আমার লোকেরাও এটা গ্রহণ করেছে।

ফ্রস্ট : আর জাতীয় সংগীত কে লিখেছেন?
শেখ মুজিব : এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরনো একটা গান।
ফ্রস্ট : আর এই গানটা বহু বছর ধরে বাংলাদেশে গীত হয়ে আসছে?
শেখ মুজিব : বহু বছর। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর ‘স্বাধীন বাংলা’ ‘স্বাধীন বাংলা’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে গ্রহণ করে নিই।
ফ্রস্ট : আচ্ছা, ৭ই মার্চ রেসকোর্সে যদি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে দিতেন, তাহলে কী হতো?
শেখ মুজিব : আমি জানতাম কী আসছে। আমি তো সেই সভায়ই ঘোষণা করে দিয়েছিলাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তি আর স্বাধীনতার সংগ্রাম।

ফ্রস্ট : আপনি যদি বলতেন, ‘আমি আজ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি,’ তাহলে কী হতো?
শেখ মুজিব : বিশেষ করে ঠিক ওই দিনই আমি এটা করতে চাইনি। ‘মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, পাল্টা আঘাত করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই,’ দুনিয়াকে এমন কিছু বলার সুযোগ আমি তাদের দিতে চাইনি। আমি চাইছিলাম, তারা আগে আমাদের আঘাত করুক, সেটা প্রতিরোধ করার জন্য আমার জনগণ প্রস্তুত ছিল।

ফ্রস্ট : কিন্তু আপনি শুরু করতে চাননি?
শেখ মুজিব : না, আমি চাইছিলাম, তারা শুরু করুক।
ফ্রস্ট : আপনি ইংলিশ তামাক খান?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, অনেক দিন।
ফ্রস্ট : এটা কি তামাক?
শেখ মুজিব : এডিন মোরস।
ফ্রস্ট : এটাই আপনার পছন্দ?
শেখ মুজিব : এটাই আমি পছন্দ করি। ১৪ বছর ধরে খাচ্ছি। এমনকি জেলেও আমি তাদের বলেছি, আমাকে অবশ্যই এই তামাক দিতে হবে। দয়া করে তারা সেটা দিয়েছেও।

ফ্রস্ট : নিঃসঙ্গ কারাবাসকালেও?
শেখ মুজিব : এই একটা ব্যাপারে অন্তত আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ [হাসি]।
ফ্রস্ট : তারা বলে, বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরম ক্ষমতা আপনার আছে। কিন্তু আবার পুরনো প্রবাদও আছে, ‘ক্ষমতা কলুষিত করে, চরম ক্ষমতার কলুষতাও চরম। ‘ ক্ষমতার দ্বারা কলুষিত হওয়া থেকে নিজেকে কিভাবে বিরত রাখবেন?
শেখ মুজিব : আপনি জানেন, ইয়াহিয়া খানের মতো মানুষ যখন দৈবক্রমে ক্ষমতায় আসে, সে কলুষিত হতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ যদি একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসে; সংগ্রাম, ক্লেশ, লড়াই করে আসে; তাকে যত ক্ষমতাই আপনি দেন না কেন, সে কলুষিত হবে না। আমি আর আমার দলের কথা যদি বলেন, আমার সব নেতাই জেল খেটেছে, সবাই তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, তাদের অনেকে স্বজন হারিয়েছে। ২৪ বছর পর তারা ক্ষমতা পেয়েছে। তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেলেও দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে, যেটা ইয়াহিয়া খান গংরা আসেনি। পশুশক্তি আর বন্দুকের নল দেখিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে। আমার লোকেরা বন্দুক ঠেকিয়ে ক্ষমতায় আসেনি, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশ ও মানুষের জন্য তাদের দরদ রয়েছে। আমার নেতা ও পার্টিকর্মীদের ওপর আমার আস্থা আছে।

ফ্রস্ট : আপনি নেতার কথা বললেন। নেতা কে? আপনাকে যদি নেতৃত্ব শব্দটাকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে সত্যিকারের নেতৃত্ব কী?
শেখ মুজিব : সত্যিকারের নেতৃত্ব একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসে। এক দিনে ঘটনাচক্রে কেউ নেতা হতে পারে না। অবশ্যই সংগ্রাম, প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এটাকে আসতে হবে। তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, তাকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে হবে। মানবজাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য তাকে তৈরি থাকতে হবে। তার অবশ্যই একটা নীতি থাকবে, একটা আদর্শ থাকবে। একজন নেতার যদি এসব গুণ থাকে, তাহলেই সে নেতা।

ফ্রস্ট : পৃথিবীর ইতিহাসের কোন নেতাদের আপনি গুণগ্রাহী?
শেখ মুজিব : অনেক নেতাকেই আমি স্বীকৃতি দিই। আজকে কারা নেতা, সেটা আর আমি উল্লেখ করতে চাই না।

ফ্রস্ট : তাহলে ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?
শেখ মুজিব : আমি আব্রাহাম লিংকন, মাও জে দং, লেনিন, চার্চিলের অনুরাগী। সাবেক প্রেসিডেন্ট মি. কেনেডিকেও আমি পছন্দ করি।

ফ্রস্ট : আর মহাত্মা গান্ধী?
শেখ মুজিব : মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্কের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি ড. সুকর্ণকেও শ্রদ্ধা করি, নিজের জনগণের মুক্তির জন্য তিনি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। এসব মানুষ লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এসেছেন।

ফ্রস্ট : এ মুহূর্তে আপনি যখন পেছন ফিরে তাকান, বিগত বছরগুলোর মধ্যে কোনটাকে আপনার সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত বলবেন? কোন মুহূর্তটা আপনাকে সবচেয়ে বেশি সুখ দিয়েছে?
শেখ মুজিব : যেদিন শুনলাম, আমার মানুষ মুক্ত হয়েছে, আমার জনগণ স্বাধীন, একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমি বাংলাদেশকে পেয়েছি। সেটাই আমার জীবনের সুখীতম দিন।

ফ্রস্ট : আর আপনি যখন ৯ মাসের মুক্তির লড়াইয়ে আপনার কিছু সহকর্মীর পরিণতির কথা শুনলেন…
শেখ মুজিব : যখন শুনলাম তারা আমার প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে, সেটা ছিল আমার জীবনের দুঃসহতম [মুহূর্ত]।

ফ্রস্ট : [ছবি বের করে] এই ছবিগুলো প্রথম দেখার পর আপনি কী বলেছিলেন?
শেখ মুজিব : আমি কী বলতে পারি। আমার বলার মতো ভাষা ছিল না। আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কাঁদতে শুরু করি। এখনো আমার চোখে পানি চলে আসে। নিষ্পাপ ছেলে, নিষ্পাপ মেয়ে, নিষ্পাপ জনসাধারণকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানি আর্মি। তারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার লোকজনদের ধর্ষণ করেছে, আমার মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে। জীবনের একটা সময়ই গেছে। আমি শক্ত মানুষ। হয়তো কেউ আমার চোখে পানি দেখেনি। কিন্তু এখন পানি আসছে, আমি থামাতে পারছি না।

ফ্রস্ট : বিগত মাসগুলোয় আপনি কতবার আপনার জনগণের জন্য কেঁদেছেন?
শেখ মুজিব : বহুবার আমি তাদের জন্য কেঁদেছি।
ফ্রস্ট : যখন আপনি শুনলেন কী করা হয়েছে?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ। যতবারই আমার মনে পড়ে, চোখে পানি চলে আসে, এখনো আসছে। একটা মানুষ কী করে পাঁচ মাস বা এক-দুই বছরের নিষ্পাপ বাচ্চাকে হত্যা করতে পারে? কী করে তারা নারী, গরিব কৃষককে হত্যা করতে পারে, যাদের খাবারটা পর্যন্ত ছিল না। এই পৃথিবীই তো ফ্যাসিস্ট জার্মানির যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ন্যুরেমবার্গ বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আমার মনে হয়, এই লোকদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের আরেকটা বিচারের ব্যবস্থা করা উচিত। আমি বরাবরই ক্ষমা ও ভুলে যাওয়ায় বিশ্বাসী; কিন্তু আমার পক্ষে ক্ষমা ও ভোলা অসম্ভব। কারণ এগুলো ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, আমার লোকজনদের নির্মূল করতে গণহত্যা। আপনার কি মনে হয়, কোনো মানুষের এসব সহ্য করা উচিত? এই লোকগুলোর অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত।
আমার মনে হয় না, আমার লোকদের নিয়ে আর কোনো রাজনীতি করা কোনো শক্তির উচিত হবে। আমি তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, মানবজাতির দোহাই, আমার দুর্ভাগা লোকদের সাহায্য করুন, তারা এখনো কষ্ট পাচ্ছে। আমার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। একজন প্রধানমন্ত্রী আর কী পেতে পারে, যা আমি আমার জনগণের কাছ থেকে পাইনি। আহতদের দেখতে গতকাল আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তাদের কেউ হাত হারিয়েছে, পা হারিয়েছে। তারা আমাকে বলল, ‘আমরা সব হারিয়েছি, তার পরও কষ্ট নাই, আপনি ফিরে এসেছেন। এটাই আমাদের তুষ্টি। এতেই আমরা সুখী। ‘ ভালোবাসা, মমতাকে কি আপনি বিনাশ করতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রিত্ব, রাষ্ট্রপতিত্ব আমার কাছে কিছু না। আমি আমার জনগণের ভালোবাসা, মমতা পেয়েছি। এটা নিয়েই আমি মরতে চাই, আর কিছু আমি চাই না। আমি সুখী, আমার জনগণ আজ স্বাধীন। তারা নিজেরাই তাদের উন্নতি করতে পারবে। তারা একটা স্বাধীন দেশে থাকতে পারছে।

ফ্রস্ট : প্রধানমন্ত্রী, আপনার কোনো প্রার্থনা আছে যার সঙ্গে দুনিয়া শামিল হতে পারে?
শেখ মুজিব : আমি সব সময় প্রার্থনা করি, আমার জনগণকে সাহায্য করতে দুনিয়া এগিয়ে আসুক। আমি সব সময় আশা করি, মানবজাতির কল্যাণার্থে আর আমার বাংলাদেশের দুর্ভাগা জনসাধারণের সাহায্যার্থে তারা এগিয়ে আসুক। দুনিয়ার কোনো দেশই স্বাধীনতার জন্য এতটা কষ্ট স্বীকার করেনি, যতটা আমার বাংলাদেশের মানুষ করেছে। আমি আপনার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, আপনি আমার বন্ধু। স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছি। আপনি দেখেছেন। আরো দেখুন, আশপাশে যান। আমার দেশে পূর্ণ আইনশৃঙ্খলা বিদ্যমান। যে প্রশ্নটা এখন আসছে তা হলো, কেউ যদি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, আপনার যা করার করবেন আর আমার শুভকামনা জানাবেন, এটাই দুনিয়ার কাছে আমার প্রার্থনা। প্রত্যেকের প্রতি আমার শুভেচ্ছা আর প্রত্যাশা- আমার লাখো ক্ষুধার্তের সাহায্যে সবাই এগিয়ে আসবেন। বন্ধু, তোমায় ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। জয় বাংলা।

ফ্রস্ট : জয় বাংলা। আমি নিশ্চিত দুনিয়া এগিয়ে আসবে। আমি আরো নিশ্চিত যদি এগিয়ে না আসে, ঈশ্বর আমাদের কখনোই ক্ষমা করবেন না।

অনুবাদ : জামিল বিন সিদ্দিক

ফ্রম Shamima Nasrin Priya আপার টাইমলাইন(এই সাক্ষাৎকার আমি মনে করি অনেকেই পড়েনাই)

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
‘আমি চাইছিলাম তারা আগে আঘাত করুক’

ডেভিড ফ্রস্ট : …নতুন একটা জাতির জন্ম হয়েছে। আর আজ সেই নয়া জাতির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে কথা বলবেন।
এটা গত কয়েক মাসের রক্তপাত নিয়ে তার গল্প, যে রক্তপাত থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। জয় বাংলা! যে রাতে অচিরেই হামলা চালাবে পশ্চিম পাকিস্তান, সে রাতে আপনি বাসায়ই ছিলেন। আমার ধারণা, রাত ৮টায় ফোনে আপনাকে সতর্কও করা হয়েছিল যে আর্মি পথে রয়েছে। তার পরও কেন আপনি থেকে যাওয়ার এবং গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন?

শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, এখানে একটা চমৎকার গল্প আছে। ওই সন্ধ্যায় কমান্ডোরা আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছিল, বাড়ি থেকে বেরোলেই ওরা আমাকে মেরে ফেলত। তারপর আমার লোকজনের নাম করে বলত, বাংলাদেশের চরমপন্থীদের হাতে মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছে। সারা দুনিয়াকে বলত, আমরা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলাম; কিন্তু চরমপন্থীরা মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, এখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়ার আর কোনো বিকল্প নেই। এবং তারা ব্যবস্থা নিত। এটাই ছিল তাদের অভিসন্ধি।
তাই ভাবলাম, তার চেয়ে বরং আমার মরাই ভালো, অন্তত আমার লোকেরা তো বাঁচবে, যারা আমাকে এত ভালোবাসে।

ফ্রস্ট : আপনি কলকাতায় চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব : যেতে চাইলে যেকোনো জায়গায়ই যেতে পারতাম। কিন্তু আমার লোকদের ছেড়ে আমি কী করে যাই? আমি তো জাতির নেতা।

ফ্রস্ট : অবশ্যই আপনি ঠিক। আর এটাই গত ৯ মাস আপনাকে এমন এক প্রতীকে পরিণত করেছে, যার ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারে। তারা তো আপনাকে এখন প্রায় ঈশ্বরই মনে করে।
শেখ মুজিব : আমি তা বলব না, আমি বরং বলব তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি তাদের ভালোবাসি, তাই তাদের জীবন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু ওই জানোয়ারেরা আমাকে গ্রেপ্তার করেছে, আমার বাড়ি ধ্বংস করছে, আমার গ্রামের বাড়ি ধ্বংস করছে, যে বাড়িতে আমার বুড়ো মা-বাবা থাকতেন। আমার বাবার বয়স ৯০ বছর, মার ৮০। তাঁরা আমার গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার এই পূর্বপুরুষের ভিটে। তারা সেখানে পর্যন্ত আর্মি পাঠিয়েছে, আমার মা-বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তাঁদের সামনে ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁদের কোনো আশ্রয় ছিল না।

ফ্রস্ট : তারা ঠিক কিভাবে আপনাকে গ্রেপ্তার করল? তখন রাত দেড়টা, তাই না? কী ঘটল?
শেখ মুজিব : প্রথমে তারা মেশিনগানে আমার বাড়ি ঝাঁঝরা করে দিল।

ফ্রস্ট : তারা যখন এলো তখন আপনি কোথায়?
শেখ মুজিব : আমি শোয়ার ঘরে ছিলাম- এটাই আমার শোয়ার ঘর। ওই দিক থেকে তারা মেশিনগান চালানো শুরু করল। এদিকেও কিছু মেশিনগান ছিল। আর ওই দিক থেকে তারা জানালা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল।

ফ্রস্ট : এই সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব : সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি পরিবারের সঙ্গেই ছিলাম। একটা গুলি শোয়ার ঘরে ঢুকল। আমার ছয় বছরের বাচ্চা বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার স্ত্রী এখানেই ছিল।

ফ্রস্ট : পাকিস্তানি ফৌজেরা কোন দিক দিয়ে ঢুকল?
শেখ মুজিব : সব দিক দিয়ে। তারা জানালা দিয়ে গুলি শুরু করল। তখন দুই বাচ্চা নিয়ে স্ত্রীকে এখানেই বসতে বললাম। তারপর বাইরে গেলাম।

ফ্রস্ট : তিনি কী বললেন?
শেখ মুজিব : একটা শব্দও [উচ্চারণ করলেন] না। তাকে চুম্বন করলাম, বিদায় চুম্বন। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম, ওদের গুলি থামাতে বললাম, ‘গুলি বন্ধ করো। এই যে আমি এখানে। কেন গুলি চালাচ্ছ, কী জন্য?’ তখন তারা, ফৌজিরা, বেয়োনেট দিয়ে চার্জ করতে চারদিক থেকে ছুটে এলো। একজন অফিসার ছিলেন, তিনি তখন এভাবে আমাকে ধরলেন, বললেন, ‘ওকে মেরো না। ‘

ফ্রস্ট : শুধু একজন অফিসার ওদের থামাল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ। তখন তারা টেনেহিঁচড়ে আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলল, পেছন থেকে তারা আমার পায়ে আঘাত করতে লাগল, এখানে-ওখানে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ধাক্কাতে লাগল। অফিসারটি আমাকে ধরে ছিল, তার পরও ওরা আমাকে ধাক্কাচ্ছিল আর নিচের দিকে টানছিল। ‘টানাটানি করো না,’ ওদের বললাম। ‘দাঁড়াও, স্ত্রীর কাছ থেকে পাইপ আর তামাকটা অন্তত আনতে দাও। ‘ আবার ওপরে এলাম। দেখি দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমার স্ত্রী দঁাঁড়িয়ে আছে। তারা পাইপ আর একটা ছোট স্যুটকেস নিল…তারা এখান থেকে আমাকে নিয়ে গেল।

ফ্রস্ট : আপনি যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কখনো এই বাড়ি দেখতে পাবেন?
শেখ মুজিব : ভাবিনি। ভেবেছিলাম, এই শেষ। কিন্তু একজন নেতা হিসেবে মাথা উঁচু করে যদি মরতে পারি, তাহলে তারা অন্তত লজ্জিত হবে না। কিন্তু আমি যদি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে আমার জাতি, আমার দেশের জনগণ দুনিয়ার কাছে [মুখ] দেখাতে পারবে না। তার চেয়ে জনগণের মর্যাদা সমুন্নত রেখে মরাই বরং ভালো।

ফ্রস্ট : আপনি একবার বলেছিলেন, ‘মরতে প্রস্তুত এমন কাউকে তুমি মারতে পারো না’ তাই না?
শেখ মুজিব : আমি তাদের বলেছিলাম মরতে প্রস্তুত এমন কোনো ব্যক্তিকে কেউ মারতে পারে না। শারীরিকভাবে একজন লোককে তুমি মারতে পারো, কিন্তু মানুষের আত্মাকে কী মারতে পারো? পারো না- এটাই আমার বিশ্বাস। আমি মুসলমান আর একজন মুসলমান একবারই মরে, দুইবার না।

ফ্রস্ট : পাকিস্তানিরা কী আপনার বাড়ি থেকে সব কিছু লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমার পুরো বাড়ি। এমনকি বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়চোপড়- সব কিছু। তারা সব কিছুই নিয়ে গিয়েছিল। দেখতেই পাচ্ছেন, কিছুই নেই…আলমারি, আসবাবপত্র, কাপড়, বাচ্চাদের পোশাক নেওয়ায় কিছু মনে করিনি, কিন্তু ওরা আমার জীবনের ইতিহাসটা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ডায়েরি ছিল। চমৎকার একটা লাইব্রেরি ছিল। মূল্যবান কয়েকটা দলিলসহ প্রতিটি বই তারা নিয়ে গেছে।

ফ্রস্ট : আপনার বিচারের কী হলো?
শেখ মুজিব : পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা আর সব বেসামরিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে তারা একটা সামরিক আদালত গঠন করল।

ফ্রস্ট : আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল তারা?
শেখ মুজিব : চক্রান্ত, পাকিস্তান সরকার ও সশস্ত্রব াহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাকে স্বাধীন করতে চাওয়া- কী নয়। ১২টা অভিযোগ, তার মধ্যে ছয়টার শাস্তি ফাঁসি।

ফ্রস্ট : আপনার আইনজীবী ছিল?
শেখ মুজিব : সরকার প্রথমে আইনজীবী দিয়েছিল। কিন্তু অবস্থা দেখে আমার মনে হলো, ‘আত্মপক্ষ সমর্থন করে লাভ নেই। এটা একটা তামাশার বিচার। এটা একটা প্রহসন। ‘ তখন আমি আদালতে দঁাঁড়িয়ে বললাম, ‘বিচারক মহোদয়, বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের দয়া করে চলে যেতে বলুন। কারণ আপনি জানেন, এটা একটা গোপন বিচার (ক্যামেরা ট্রায়াল)। আমি কোনো সামরিক ব্যক্তি না, একজন বেসামরিক মানুষ অথচ তারা আমাকে সামরিক আদালতে বিচার করছে। জনাব ইয়াহিয়া খান

আপনার মতামত প্রকাশ করেন

আপনার মন্তব্য দিন
আপনার নাম এন্ট্রি করুন