মহাপ্রতারক -সেলফি সাহেদ করিম প্রতারক জগতের আইডল

0
27

মোঃ নাসির, বিশেষ প্রতিনিধিঃ রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের ছবি রয়েছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের সপ্তম উপপ্রধানমন্ত্রী জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রবীণ নেতা এল কে আদভানি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, সেনাপ্রধান, র্যাবপ্রধান, পুলিশপ্রধান, তিন বাহিনীপ্রধান, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক নেতা, বিরোধী দলের নেতা, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল তার পদচারণ। এমনকি বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতার সাথেও তার ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। এই ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই ছিল তার প্রতারণা। বাংলাদেশের এমন কোনো হর্তাকর্তা নেই, যার সাথে সে ছবি তোলেনি। যেভাবে প্রতারণার শুরু

মানুষের সাথে প্রতারণার শুরু এমএলএম কোম্পানির মাধ্যমে। প্রতারণা আর চাপাবাজি দিয়েই উত্থান হয়েছিল তার। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। অন্তত তিন ডজন মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিজেকে কখনো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনো গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়-সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। এমনকি নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টক শোতে অংশ নিয়েছেন তিনি। বহুরূপী এই প্রতারকের কাল হয়েছে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে জালিয়াতি করা। শুধু করোনা চিকিৎসায় জালিয়াতি নয়, রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের তিনটি ভবনই বিভিন্ন ফন্দি করে ভাড়া নেন। মিরপুরের ১২ নম্বরের যে বাড়িটিতে হাসপাতাল করা হয়েছে, সেটি অন্য আরেকজনকে দিয়ে ভাড়া করিয়েছিলেন। পরে সেখানে জোর করে হাসপাতাল স্থাপন করেন। দুই বছর ধরে এর ভাড়াও দেননি সাহেদ। উত্তরাতেও একই অবস্থা। ভুক্তভোগী বাড়িওয়ালা উকিল নোটিশ দিয়ে ও থানায় নালিশ করেও তাকে সরাতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরকে সাহেদের বিষয়ে সতর্ক করার পরও ঢাকার বাইরে তিনি পেয়েছেন পুলিশ প্রটেকশন।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন তিনি। গত ৭ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে নিয়মিত মামলাও।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বেশ কয়েক দিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখানে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে তারা জালিয়াতি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। রিজেন্টের মালিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সাহেদকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় একবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এর কয়েক বছর আগেই হাসপাতালের অনুমোদন নিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া অনুমোদনহীন ‘আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি’ খুলে ১২টি শাখার মাধ্যমে হাজার হাজার সদস্যের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সাহেদ। এর আগে উত্তরার ৪, ৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে ভুয়া শিপিংয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। নিজের অপকর্ম চালাতে ছিল তার বিশাল ক্যাডার বাহিনী। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেন তিনি। চলাফেরা করতেন ফ্লাগস্ট্যান্ড আর ভিআইপি হর্নযুক্ত গাড়িতে। সব সময় থাকত অস্ত্রধারী দেহরক্ষী।
সূত্র জানায়, এবার ভিন্ন কৌশলে চলা শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন সরকারি দফতরে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পনসর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। যাতে সবাই বুঝতে পারে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চলাফেরা রয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট মালিক সাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। এ জন্য গাঁটের টাকা খরচ করে বিভিন্ন টক শোতে অংশ নিতেন বলেও জানা গেছে। টক শোতে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে বেশি বেশি সমালোচনা করা সাহেদের বিরুদ্ধে একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও শোনা গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকাও খুলেছেন তিনি। নিজেকে সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। এসবই ছিল তার বিভিন্ন অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচানোর ঢাল। সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছে র্যাব।
রিকশা ও ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবসাও করতেন সাহেদ। ১১ জুলাই উত্তরায় প্রধান শাখায় অভিযান চালিয়ে রিকশা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার করে র্যাব। লাইসেন্সগুলোতে ইস্যু দানকারী হিসেবে সাহেদের নাম ও নম্বর থাকত। পাঁচ শতাধিক রিকশা ও প্রায় দুই শ ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স উদ্ধার করা হয়।
গোপনে তিন বিয়ে ও পাঁচ বান্ধবী
ব্যক্তিগত জীবনেও বহুরূপী প্রতারক। জালিয়াতি প্রকাশের পর সাদিয়া আরাবী নামের এক স্ত্রীর পরিচয় জানা গেলেও সহকর্মীরা বলছেন, তারা সাহেদের আরো দুই স্ত্রী দেখেছেন। একজনের নাম চৈতি। এ ছাড়া লিজা ও মার্জিয়া নামে সাহেদের অফিসে দুই নারী কর্মকর্তা আছেন। তাদের একজন তার বিয়ে করা বউ বলেও সন্দেহ কর্মীদের। একাধিক স্ত্রী থাকলেও পরস্পরের কাছে বিষয়টি এত দিন গোপন থেকে গেছে।
তদন্তকারী ও সহকর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, লিজা ও মার্জিয়া ছাড়াও সাদিয়া ও হিরা মণি নামের দুই তরুণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সাহেদের। পাসওয়ার্ড দেওয়া প্রাইভেট রুমে তাদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। কাজ হাসিল করতে সুন্দরী পাঁচ বান্ধবীকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন সাহেদ।
ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনে ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর : আর্থিক জালিয়াতির জন্য বহুরূপী সাহেদের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর। লেনদেনের ক্ষেত্রেও তিনি ভিন্ন স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন। একেকটি লেনদেন দেখার দায়িত্বে ছিলেন একেকজন সহযোগী। বারবার নাম পাল্টানোর নেপথ্যে অপকর্ম আর প্রতারণাকে বৈধ করাই ছিল রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের উদ্দেশ্য। প্রতারণার মাধ্যমে তিনি দুটি হাসপাতালের মালিক, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। এত দিন মানুষ তাকে সমাজের প্রভাবশালী আর সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জানলেও রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে সাহেদের নানা কুকীর্তির কাহিনি।
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের ওয়েবসাইটে তিনি নাম লিখেছেন মো. সাহেদ। হাসপাতালের নথিতেও তা-ই। ‘নতুন কাগজ’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকারও ‘সম্পাদক’ এবং প্রকাশকও স্কুল পাস মো. সাহেদ। কিন্তু পত্রিকাটির নামে সরকারি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডে তিনি নাম ব্যবহার করেছেন মোহাম্মদ সাহেদ। তথ্য অধিদপ্তরের অস্থায়ী এই কার্ড নম্বর ৬৮৪৫।
প্রশ্ন উঠেছে, বহুরূপী এই প্রতারককে নেপথ্যে থেকে কারা দীর্ঘ দিন ধরে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন? কাদের কারণে বারবার অপকর্ম করেও পার পেয়েছেন তিনি? জেল থেকেও বেরিয়ে কী করে আবারও জড়িয়েছেন একই ধরনের প্রতারণায়? এত মামলা আর অভিযোগ নিয়ে প্রতারক সাহেদ সমাজের মূল স্রোতধারায় যেভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন এবং করোনা হাসপাতাল হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাতে পর্যবেক্ষকেরাও বিস্মিত।

কোন মন্তব্য নেই