সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আমরা ব্যর্থ

0
38

এমএইছ চৌধুরী, জুনাইদ শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) থেকে :: ১৯৫২ থেকে ২০১৯ সাল, পেরিয়ে গেল দির্ঘ ৬৭ বছর। আমরা আজ অবধি দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি।এটা আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। ১৯৪৭ সালে জাতী ও ধর্ম তত্তে¦র ভিত্তিতে প্রায় ২শ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে ভাগ হযে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি সর্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। পাকিস্তান ২টি ভূখন্ডে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল।

১৯৪৮ সালে হঠাৎ করে পাকিস্তান সরকার উর্দু ভাষাকে উভয় পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এ হঠকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিযার দানা বাঁধে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ এ আকস্মিক ও অন্যায্য সিদ্ধান্তকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি দ্রুত বেগবান হতে থাকে। ওই সময় দুর্বার আন্দোলনরত জনতাকে দমন করতে পকিস্তান পুলিশ কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তারা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সকল প্রকার মিছিলসহ সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ও বেআইনি ঘোষণা করে।

আন্দোলনরত ছাত্র জনতা এই হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুযারি পাকিস্তান সরকারের জারিকৃত কালো আইন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে আসে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভীক ছাত্রজনতা মিলে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ওই মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছুলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অজুহাতে আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ওই নির্মম গুলিবর্ষণে ঘটস্থলেই নিহত হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেক দেশ প্রেমিক তরুণ। এতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকার পিচঢালা রাজপথ শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এই নির্মম ঘটনার প্রেক্ষাপটে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা ছড়িয়ে পডে সমগ্র পূর্ব পকিস্তান ব্যাপী এবং ঘৃণিত কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত হয় বিশ্বময়।
অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তান কেন্দ্রীয সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকারের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।

এর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাভাষী মানুষ এবং কৃষ্টির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২১ ফেব্রুযারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। যা বিশ্বময় গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আমাদের দেশের অকুতোভয় দামাল ছেলেরা আত্মোৎসর্গ করতে ছিল নির্ভীক। প্রতি বছর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির আগমনে আমরা শোকাহত, আবেগাপ্লুত হয়ে পরি। আমরা শোকাহত, মর্মাহত হয়ে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, প্রভাতফেরী, স্মরণসভা ইত্যাদির মাধ্যমে দিবসটি পালনে সীমাবদ্ধ। ১৯৫২ থেকে ২০১৯ সাল, পেরিয়ে গেল দির্ঘ ৬৭ বছর। আজও আমরা দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করতে পারিনি। আমাদের দাপ্তরিক ভাষা এখনো শতভাগ বাংলা প্রচলন করতে পারিনি। বিশেষ করে উচ্চতর বিচার বিভাগের নথিগত ভাষা এখনো শতভাগ বাংলা হয়নি। মাঝে মধ্যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবী উঠলেও তা বাস্তবায়নে নেই কোন শক্তিশালী উদ্যোগ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে ইংরেজী, উর্দু, ফার্সীসহ অন্যান্য ভাষার ব্যবহার হচ্ছে এবং থাকবে এটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ ছাড়া পথেঘাটে, ব্যবসা বানিজ্যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সর্বত্রই ইংরেজী ভাষার আধিক্ষেতা পরিলক্ষিত হয় যা মোটেই কাম্য নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলনে, বলনে, পরিধাণে, সংষ্কৃতিতে, আনন্দ বিনোদনে, সর্বাঙ্গে বিদেশী ভাষার ব্যবহার আমাদের অনুষঙ্গ।

তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এ মায়ের ভাষার পূর্ণ মর্যাদা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। ভাষার মর্যাদা সুরক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়ার নজির এ পৃথিবীতে আর নাই। প্রাণের বিনিময়ে বাংলা ভাষা সুরক্ষার জন্য আমারাই এ জগতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবো যুগ যুগ ধরে। তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে প্রত্যেককেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে স্ব-স্ব অবস্থানে সচেষ্ট হতে হবে। যে দিন আমাদের এই প্রচেষ্টা শতভাগ সফল হবে সে দিনই ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের সঠিক মর্যাদা ও মূল্যায়ন নিশ্চিত হবে।

আপনার মতামত প্রকাশ করেন

আপনার মন্তব্য দিন
আপনার নাম এন্ট্রি করুন