সাংবাদিক হতে হলে পুলিশকে না-কি বাপ ডাকতে হবে!!?

0
74

সাংবাদিক হতে হলে পুলিশকে না-কি বাপ ডাকতে হবে(!!!)

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে,
” একদল পুলিশ সদস্য ৩ জন সংবাদকর্মীকে একটি ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়ে লাথি উষ্ঠা মারছে। সেই সাথে পুলিশকে বাপ ডাকতে বলছে! এই দৃশ্য দুজন পুলিশ সদস্য তাদের মোবাইলে ধারণ করছে এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করছে! ক,,, ক,,, শালার পুত, পুলিশ কি লাগে ক,,,। ক,,, বাপ ,,,,! বাপ ডাক,,,,,!” সংবাদকর্মী নির্যাতনের এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুর সদর জয়দেবপুর থানায়। ২০২০ সালের ৩১ মে গভীর রাতে। পরদিন তাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

ভাইরাল ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেকের মতো আমিও স্তম্ভিত, ব্যথিত এবং ভেতর থেকে প্রচন্ড রকম আহত হয়েছি।অনেকেই এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আজকে নতুন করে আপনাদের জানাতে হচ্ছে । কারণ, সম্প্রতি যে ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে তা এতোদিন জনসম্মুখে আসেনি, তাই সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব ছিলো না। দীর্ঘ ৩ বছর পর এই ফুটেজ পাওয়া গেছে। এখন নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হবে। তবে এটি কিভাবে পাওয়া গেলো, সেই তথ্য জানার আগে নিচের লেখাটা পড়তে হবে। একটু মনোযোগ দিয়ে পুরো লেখাটি পড়ুন। কারণ, এই ঘটনার সাথে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

নির্যাতিত সংবাদকর্মী মোজাহিদ জেল থেকে বের হয়ে পুলিশের আইজিপি বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। কি এক দুর্বোধ্য কারণে সেই অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। অথচ আইজিপি মহোদয় সবসময় বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তার তদন্ত হয় এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ব্যাক্তির অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না। অথচ এ বিষয়ে দৃশ্যপট ভিন্ন।

নিরুপায় হয়ে অবশেষে, নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মোজাহিদ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো।

“গাজীপুরে আমাকেসহ তিন সাংবাদিককে সন্ত্রাসী স্টাইলে আটক করার পর একটি নোয়া গাড়িতে তুলে (জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজাল) এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। পরে থানায় নিয়ে দীর্ঘ তিন ঘন্টা নির্যাতনের পর তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি চাইলে আমাদের মুখে প্রস্রাব ঢেলে দেয় আফজাল!

ওই আটককৃত তিনজন হলেন, দৈনিক যোগফলের স্টাফ রিপোর্টার মোঃ মোজাহিদ (আমি), সদর উপজেলা প্রতিনিধি রুকুনুজ্জামান খান ও দৈনিক মুক্ত বলাকা’র স্টাফ রিপোর্টার মিলন শেখ।

পরে আটককৃতদের ব্যাপক মারধরের পরদিন মামলার এজাহার বদলের নাটকীয়তা শেষে আটকের ২০ ঘন্টা পর জয়দেবপুর থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা নম্বর ১ (৬) ২০ দায়ের করে ওইদিন সন্ধ্যায় আদালতে পাঠানো হয় আমাদের। ওই খবর জাতীয় দাবিদার (দালাল মিডিয়া) সম্পূর্ণ চেপে যায়।

পরে দীর্ঘ ৯০ দিন কারাবাসের পর
নির্যাতিত (অবহেলিত) সাংবাদিকরা গত শুক্রবার (২৮ আগস্ট ২০২০) দুপুর বারোটা ১৫ মিনিটে গাজীপুর কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ওই নির্যাতনের প্রভাব এখনও তিনজনের শরীরেই রয়ে গেছে। আমার দুই হাতের কব্জিতে এখনও ঠিকমতো শক্তি পাইনা। শুধু তাই নয়, গতরাত থেকে আমার অবস্থা আশংকাজনক। হয়তো যে-কোনও সময় মারা যেতে পারি। আমি মারা গেলে এই লেখাটাকে অন্ততঃ সুইসাইট নোট বলে চালিয়ে দিয়েন না। গতরাত থেকে আমার অবস্থা আশংকাজনক। আমি মারা গেলে এর জন্য অনেকটাই দায়ী জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজাল।

আমি সরল চিত্তে জানাচ্ছি, আমরা গত রোববার (৩১ মে ২০২০) সদর উপজেলার বাঘেরবাজারে (ভাওয়াল মিডিয়া সেন্টারে) একটি অনুসন্ধানী খবর লেখার কাজ করছিলাম। পরে রাত পৌনে ১১ টায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফিল্মি স্টাইলে পরিদর্শক আফজালের নেতৃত্বে আমাদেরকে গাড়িতে তুলেই মারধর শুরু করে।

ওই সময় অর্থাৎ (গাড়িতে তোলার পর) জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজালের নেতৃত্বে তিনজনকেই শারীরিক টর্চার করেন এসআই সাদেক, এসআই আব্দুর রহমান, এএসআই খাইরুল, এএসআই ইউনুস ও পিএসআই মামুনুর রশীদ।

গাড়িতে মেরেই তারা ক্ষান্ত হননি! আমার গলায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আফজাল বলেন, “বুড়িগঙ্গা নদীতে তোদের মতো ৭ টা সাংবাদিককে মেরে ফেলে দিছি, আমার কিছুই হয় নাই! আমাকে কিছুই করতে পারবিনা তোরা”! তোদের তিনজনকে মেরে ফেললেও কিছুই হবে না আমার”! তখন এএসআই ইউনুস এবং মামুনুর রশীদ তখন বলেন, “স্যার এদেরকে রাজেন্দ্রপুর জঙ্গলে নিয়ে ক্রসফায়ার দিয়া দেন। ঠিক তখনই পরিদর্শক আফজালের মোবাইলে যোগফল সম্পাদকের কল আসতে থাকে। তারা সম্পাদক জেনে ফেলছে ভেবে ক্রসফায়ারের চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নেওয়ার পর তিনজনের উপরই শুরু হয় সংজ্ঞাহীন নির্যাতন।

আমাদেরকে থানায় নেওয়ার পর পরিদর্শক আফজাল আমার, রুকন ও মিলনের হাত, পা, চোখ এবং মুখ বেঁধে একটানা তিন ঘন্টা লাঠিপেটা করে। রাত দুইটার দিকে মুখ খোলার পর তৃষ্ণায় ‘পানি পানি’ করে চিৎকার করলে পরিদর্শক আফজাল প্যান্টের চেইন খুলে তিনজনেরই মুখে প্রস্রাব করে দেয়! পরে এসআই সাদেক, এসআই আব্দুর রহমান, এএসআই খাইরুল, এএসআই ইউনুস, পিএসআই মামুনুর রশীদ ও কনস্টেবল আনোয়ার এরা সবাই (বোতলে) প্রস্রাব করে তিনজনের মাথায় ঢেলে দেয়। পরদিন শার্টে দুর্গন্ধ থাকায় ২০ ঘন্টায় থানায় এক গ্লাস পানিও খাইনি। জেলে গিয় (১ জুন ২০২০) রাতে পানি ও খাবার খেয়েছিলাম।

প্রস্রাব মাথায় ঢালার সময় ভিডিয়ো করছিল এএসআই খাইরুল এবং পিএসআই মামুনুর রশীদ। প্রশ্রাবে তিনজনেরই পড়নের জামা কাপড় ভিজে গেছিল। শুধু তাই নয়, ভিডিয়ো করার সময় উপস্থিত সকল পুলিশ হাসাহাসি করছিল আর বলছিল আর জীবনে সাংবাদিকতা করবি ? তখন জুতা পড়া অবস্থায় পরিদর্শক আফজাল সাংবাদিক (মোজাহিদের) আমার দুইটা হাত পিষে পিষে বলছিল সাংবাদিকতা করার রস মিটিয়ে দেবো। তোরা পুলিশের নামে খবর লিখিস কেন ? পুলিশ কি তোদের বাপ লাগে ? সেই থেকেই দুইটা হাতেই আগের অর্ধেক শক্তিও পাইনা।

আমি দুইটা হাতই মুঠ করতে পারতাম না ওই নির্যাতনের পর থেকে। জেলে গিয়ে কয়েক দফা চিকিৎসা করার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল, আমার দুই পায়ের পাতায় ও শরীরে দুইটা লাঠি ভেঙেছিল আফজাল, কোমরের নিচে হাঁটুর উপরে লাঠি ভেঙে চিকন চিকন লাটির শলা ঢুকে প্যান্ট রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিকমতো হাঁটতে পারলেও দুইটা হাতেই বর্তমানে আগের মতো শক্তি পাচ্ছি না। গলায় যেভাবে চেপে ধরেছিল তখন মনে হয়েছিল আর এক সেকেন্ড এভাবে চেপে রাখলে মারা যাব। ওই সময়ের দাগ হওয়া গলায় এখনও চিহ্ন আছে, এখনও ব্যাথা রয়ে গেছে।

সাংবাদিক রুকনকে লাঠি দিয়ে মারধরের পাশাপাশি এএসআই ইউনুস নাকেমুখে এলোপাথাড়ি মেরে তার চেহারা বিকৃত করেছিল। ওই সময়ের থানা ও জেলখানায় তোলা ছবিতে এর প্রমাণ রয়েছে। যদিও ধরা খাওয়ার ভয়ে ওই ছবিটা ডিলিট করে দিয়েছে জয়দেবপুর থানা পুলিশ।

সাংবাদিক মিলন শেখকে (আমাদের প্রায় সমপরিমাণ) লাঠিপেটা করার পাশাপাশি ডান পায়ের হাঁটুর পাঁচ ইঞ্চি নিচে রক্তাক্ত করে ফেলে। প্রায় দুই সপ্তাহ ঠিকমতো হাঁটতে পারিনি সে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের তীব্রতায় প্রায় ১৫ দিন নাকে কোনও গন্ধ পেতোনা। এখনও তার পায়ের ক্ষত চিন্হটা রয়েছে। আমার কথাগুলোর সরাসরি স্বাক্ষী অথবা প্রমাণ দেখাতে না পারলেও জেলখানার হিস্ট্রি কার্ড (কেইস কার্ড) দেখলে অন্ততঃ দেখতে পারবেন কত দফা ব্যাথানাশক এন্টিবায়োটিক খেতে হয়েছে। সেই পুরোনো ব্যাথাগুলো শরীরের প্রত্যেকটা রগে রগে আবার দেখা দিয়েছে। আল্লাহর কাছে একটাই ফরিয়াদ, আমি জীবিত থাকলে এই পুলিশগুলোর বিচার না হলেও মারা যাওয়ার পর যেন বিচার হয, শ্রেষ্ঠ বিচারপ্রতি ঠিকই বিচার করবেন। আমিন।”

সময় টেলিভিশন নির্যাতিত সংবাদকর্মীদের বিষয় নিয়ে নিউজ প্রচার করে। তবে, অভিযোগ প্রমাণ করার মতো কোনো জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি তখন। এরপর শুরু হয় আরেক ঘটনা। মূল অভিযুক্ত আফজাল কে বিভিন্ন থানায় বদলি করতে থাকে। আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কারো বিরুদ্ধে।

এরপর সময় কেটে যায় দীর্ঘ ৩ বছর। অন্যান্য অভিযুক্ত পুলিশদের মধ্যে পিএসআই মামুন বর্তমানে শ্রীপুর থানায় কর্মরত। যে মামুনের মোবাইলে ধারণ করা হয় সাংবাদিক নির্যাতনের সেই ভয়াবহ দৃশ্য। সেই ভয়াবহ দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি এসআই মামুনুর রশীদ এমন একজনকে সরবরাহ করে, যে বর্তমানে সাংবাদিক মোজাহিদের উপর হামলা করা সন্ত্রাসীদের মধ্যে একজন। তার আইডি থেকে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হয় মোজাহিদকে সামাজিক ভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাতে করে মোজাহিদের লাভ হয়, ২০২০ সালে নির্যাতিত হওয়ার প্রমাণ হিসাবে ভিডিওটি দারুণ কাজে লেগে যাবে এটা নিশ্চিত।

প্রশ্ন হলো, পুলিশের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ ৩ বছর ধরে সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্য কি? এসআই মামুন এটি অপরাধীদের হাতে দেওয়ার কারণ কি? কি ছিলো উদ্দেশ্যে? পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করা, নাকি সাংবাদিক মোজাহিদকে হেনস্তা করা? নাকি এসআই মামুনের পাপ তাকে এই কাজটি করতে বাধ্য করেছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে, আজ শনিবার (১৯ আগস্ট) রাত ৮ টায় আমি এবং সংবাদকর্মী মোজাহিদ মুখোমুখি হই এসআই মামুনুর রশীদের। গাজীপুরের শ্রীপুর থানার একটি কক্ষে কথা হয়। এসআই মামুনুর রশীদকে নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় আপনি আছেন কিনা। তিনি সরাসরি অস্বীকার করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। প্রথমে বলেন আড়াই বছর ধরে শ্রীপুর থানায় চাকরি করেন তিনি, এখান থেকেই চাকরি শুরু। অন্য কোনো থানায় থাকেননি। কন্ঠটা আপনার কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কন্ঠের সাথে কিছুটা মিল আছে, তবে তা আমি নই। জয়দেবপুর থানায় আপনি ২০২০ সালের মে মাসে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এপ্রিলে ছিলাম। মে মাসে আমি কোর্টে ছিলাম। এসময় তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে ভিন্ন চিত্র, যে চিত্রে ছিলো সত্য লুকানোর এক ব্যর্থ চেষ্টা।

সংবাদকর্মী মোজাহিদ জানান, খুব শীঘ্রই আইজিপি বরাবর দেয়া অভিযোগের সাথে সম্প্রতি হাতে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ সংযুক্ত করবেন এবং সরকারের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করবেন। আমরাও এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি! ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটাই সকলের প্রত্যাশা।


লেখক,
আনোয়ার হোসেন, সংবাদকর্মী।

কোন মন্তব্য নেই