স্বাস্থ্যমন্ত্রী-ও-ডিজির বাহাস:খুলবে প্যানডোরার বাক্স?

0
92

মোঃ নাসির,বিশেষ প্রতিনিধিঃ রিজেন্ট কেলেঙ্কারি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বাহাস শুরু হয়েছে। ‍এই বাহাসে জড়িয়ে পড়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। এই ঘটনার সূত্রপাত হয় রিজেন্ট কেলেঙ্কারির পর পর। সে সময় রিজেন্টের সঙ্গে কিভাবে চুক্তি হলো এবং যে হাসপাতালের আইনগত বৈধতা নেই, সেই হাসপাতালের সঙ্গে কিভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চুক্তি করলো তা নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়, সেই বিবৃতিতে বলা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই চুক্তি সাক্ষর করা হয়েছে।

এরকম বক্তব্যের পর ক্ষুদ্ধ্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে তিরস্কৃত করা হয় এবং তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন যে, এটা কারণ দর্শানোর নোটিশ নয়, এটা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যা চাওয়া আর কারণ দর্শানোর নোটিশের মধ্যে পার্থক্য কি এটা যারা সরকারি নোটিশ সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান রাখেন তাঁরা জানেন। দুটো আসলে একই, শুধুমাত্র ভিন্ন শব্দ চয়ন। ব্যাখার পরপরই ক্ষেপে ওঠেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন যে, জবাব চেয়েছে জবাব দেওয়া হবে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই এটা করা হয়েছে বলে তিনি আবার উল্লেখ করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এটাও বলেন যে, সবকিছু কাগজপত্রে হয়না, টেলিফোনেও অনেক কথা হয়, ফাইলই কথা বলবে। এর পরদিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন যে, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল তখন তিনি কাকতালীয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন। অন্য একটি অনুষ্ঠান ছিল, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীর মতে এটা ছিল একটি সমন্বয় সভা। এই অনুষ্ঠান শেষে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁকে একটু থাকতে বলেন এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে তাঁকে জানানো হয়। তিনি খুশী হন যে, একটি বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড চিকিৎসায় এগিয়ে আসছে, সেসময় বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড চিকিৎসায় অনাগ্রহ দেখাচ্ছিল। এরপর তিনি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, এটুকুই।

এখন রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির মূল হোতা কে এই নিয়ে মন্ত্রী এবং ডিজি কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করছেন। দুইজনের মধ্যে বাহাস হচ্ছে। এই বাহাসটি বহুল কাংখিত এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাই এই বাহাসের প্রতীক্ষা করছিলেন। কারণ দুজন দুজনকে আক্রমণ করার ফলে দুজন দুজনার হাঁটে হাড়ি ভাঙ্গতে পারেন এবং দুজন দুজনের যত অপকর্ম, সেই অপকর্মের ফিরিস্তি দিতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ডের অভাব তা স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সখ্যতার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল। দুজন দুজনকে সহযোগিতা করার ফলে একের পর এক অনিয়ম ঘটেছিল বলেও একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হকের পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। এর পর পরই তিনি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং প্রতিমন্ত্রীকে অনেকটা তাঁর কব্জায় নিয়ে আসেন। এরপর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান জাহিদ মালেক। এই দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের উপর। আর এজন্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদবির করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে আবুল কালাম আজাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করিয়ে নেন দুই বছরের জন্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে গিয়ে তিনি মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষা করেন এবং সচিবের সঙ্গে দুরত্ব তৈরি হয়। দুজনের এই ঘর-সংসার ভালোই চলছিল, কিন্তু গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মধ্যে প্রথম দুরত্ব সৃষ্টি হয়। এই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মালয়েশিয়া গেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করা বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা করার সৌজন্যতা দেখাননি বলে মন্ত্রী গোস্বা করেন এবং এই গোস্বার কথা কারো অজানা ছিল না। এরপর থেকে দুজনের দুরত্ব শুরু হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সমঝোতায় চলতেন। উপর মহলে তাঁর কানেকশন ভালো- এই কারণে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে খুব একটা ঘাটাতেন না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুজন মিলেমিশে বিভিন্ন অনিয়মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন।

জানা যায় যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত যে অনিয়ম, দুর্বৃত্তায়নগুলো ঘটেছে তাঁর সবগুলোর সঙ্গে হয় মন্ত্রী না হয় মহাপরিচালক জড়িত। প্রথম অনিয়ম ঘটে এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে। এই অনিয়ম নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জড়িত করে একাধিক গণমাধ্যম রিপোর্ট প্রকাশিত করেছে। এছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে বিভিন্ন ঠিকাদারদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও একাধিক খবর গণমাধ্যমে এসেছে।

সিএমএইচডি’র বিদায়ী পরিচালক এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু অভিযোগ উত্থাপন করেছে। যে অভিযোগগুলো তদন্ত হওয়ার দরকার থাকলেও এখন পর্যন্ত সেগুলোর তদন্ত হয়নি। দুজনার মধ্যে মিলেমিশে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়ার এই ঘটনাগুলো চলছিল, কিন্তু এখন দুজন দুজনার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুললেন। এই মুখ খোলা কি এখানেই শেষ হবে নাকি এটা কেবল শুরু? এর ফলে খুলে যাবে প্যানডোরার বাক্স এবং বের হয়ে যাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কালো অধ্যায়? আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

আপনার মতামত প্রকাশ করেন

আপনার মন্তব্য দিন
আপনার নাম এন্ট্রি করুন