মোঃ নাসির,বিশেষ প্রতিনিধিঃ বিতর্কিত হাসপাতাল রিজেন্ট ও জেকেজির সঙ্গে করোনা টেস্ট ও সেবার চুক্তির দায় কার! এমন সমালোচনার মধ্যে মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র জমা দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা এ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সরে গেলেও নেপথ্যে রয়েছে পাহাড়সম অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে নিয়মিত ডিজি, অতঃপর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রায় দশ বছরে অধিদপ্তরে একটি বলয় তৈরি করেন। কখনও নিজে, কখনও পর্দার অন্তরালে থেকে দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশয় দিয়েছেন। এমন সব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আসার পরও অদৃশ্য শক্তির কারণে এতদিন ছিলেন বহাল তবিয়তে।
করোনায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশার মধ্যে যখন ডিজির নাম প্রকাশ্যে আসছিল, তখনও তিনি দিব্যি উষ্মা প্রকাশ করে গেছেন বলেছেন,গ্রেড-১ কর্মকর্তা আমি। মন্ত্রী-সচিব চাইলেও আমাকে সরাতে পারবে না। শেষমেষ তাকে সরে যেতে হলো। ভুক্তভোগীরা এতদিন মুখ না খুললেও এবার মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এমনকি করোনা কেলেঙ্কারির দায়ে রিমান্ডে থাকা সাবরিনা-শাহেদরা ঘুরেফিরে তার নামই বলছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকারের হাইকমান্ডকে জানানোর পরপরই তিনি বুঝে যান তাকে যেতে হবে। তার পদত্যাগের একদিন পরই অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া-নেয়ার সব দুর্নীতির নেপথ্যে ডিজি-পরিচালকের নাম এখন সামনে আসছে।
ডিবি সূত্র জানায়, সাবরিনা ছিলেন ডিবি তেজগাঁও জোনে ও সাহেদ রয়েছে ডিবি উত্তরা জোনের রিমান্ডে। দুজনকে আলাদা আলাদা জোনে রাখা হলেও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাদের মুখোমুখি করে গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার অফিসে তাদের মুখোমুখি করা হলে তারা দুজনেই তাদের মদদদাতা হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও হাসপাতাল (ক্লিনিক) শাখার পরিচালকের নাম বলেন। বিষয়টি দ্রম্নত ধামাচাপা দেওয়ার নির্দেশ ছিল কালাম গংদের। তার এগুলো ধামচাপার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। এর আগেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, দশ মিনিটের মুখোমুখিতে তারা বেশ কয়েকজনের নাম বলেছেন। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ চলছে।
অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলেন, টানা দুই মেয়াদে মহাপরিচালকের চেয়ারে বসে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবুল কালাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন। নিয়মিত চাকরি শেষে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ ২ বছরের জন্য ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ডিজি হন। লম্বা এ সময়ে তাকে জড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তিনি থেকেছেন পর্দার অন্তরালে। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একের পর এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ পাওয়ায় তার শেষ রক্ষা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ঔষাধাগারের (সিএমএসডি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডা. আজাদ বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সদস্য বলে তকমা থাকলেও সরকার পরিবর্তনের পরপরই নিজের খোলস পাল্টিয়ে আওয়ামীপন্থী হয়ে দুই মেয়াদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বনে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চিকিৎসকদের নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহের কেলেঙ্কারীর মধ্যে দিয়ে ডা. আজাদের অনিয়মের গোমর ফাঁস শুরু হয়। এরপর রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজির জালিয়াতি সামনে আসায় তাকে তোপের মুখে পড়তে হয়। এক পর্যায়ে তিনি রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুললে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। যার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেন।
মহাপরিচালকের পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির দুইজন সদস্য যায়যায়দিনকে বলেন, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত মহামারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সরকার মহাপরিচালকের নেতৃত্বে জনস্বাস্থ্যবিদদের ওপরই আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পাশাপাশি নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় স্বাস্থ্যবিভাগ। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় এই প্রতিষ্ঠান। যার উদাহরণ শুরুতে নমুনা পরীক্ষায় কাউকে পাত্তা না দিয়ে শুধুমাত্র আইইডিসিআরের ওপর দায়িত্ব দেওয়া। অথচ আইইডিসিআরের মূল কাজ রোগতাত্ত্বিক গবেষণা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংসহ সার্বিক বিষয়ে মনিটরিং ও সে অনুযায়ী করণীয় সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। এতসব ভুলের মধ্যেও মানুষ যখন করোনা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছে ঠিক তখন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও দুই-তিন বছর থাকবে বলে মন্তব্য করেন। এ বক্তব্যের পর তোপের মুখে পড়ে দুঃখও প্রকাশ করতে হয় তাকে।
আবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্তসংখ্যক আইসোলেশন ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন শয্যা নিশ্চিত আছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি ফাইল পাঠান তিনি। পরে গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে তার সত্যতা পাননি। এরপর রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পাশাপাশি রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসায় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসব হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেশজুড়ে সমালোচনা তৈরি হয়।
একইভাবে পিপিই তথা বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে এন-৯৫ মাস্কের মোড়কে বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করার প্রতিবাদ করায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে বদলি এবং মুগদা মেডিকেলের পরিচালককে ওএসডি করা হয়। ২২ মে সিএমএসডি পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে গত ৪ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়। সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল শাখার অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। করোনার শুরুর দিকে বেসরকারি হাসপাতালকে করোনার চিকিৎসতায় যুক্ত করতে তাদের তৎপরতা ছিল বেশ সন্দেহজনক। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১ ডজন কর্মকর্তা ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পসহ মোট চারটি প্রকল্পে দায়িত্ব পালনকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীরকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ তার আগ্রহেই করোনা টেস্টে জালিয়াতির অভিযোগে সিলগালা প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়। এমনকি জেকেজিকে নমুনা টেস্ট অনুমোদন দেওয়ার আগে তিনি নিজে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করেন। গত ২১ মার্চ করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। পরে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারির ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চাওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সচিব আসাদুল ইসলামের নাম বলেন। কিন্তু সচিব এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। এসব অনিয়মের ব্যাপারে মহাপরিচালক হিসেবে দায় এড়াতে পারেন না বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ঔষাধাগারের জন্য ৯০০ কোটি টাকার সামগ্রী কেনা হয়। যা নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ নির্ধারিত একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য কেনায় প্রতিটি পণ্যের দাম ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দেখানো হয়। প্রায় ৫০ জোড়া এক্সামিনেশন হ্যান্ড গস্নাভসের বাজারমূল্য মাত্র ১৮০ টাকা হলেও একসেট এক্সামিনেশন হ্যান্ড গস্নাভসের দাম দেখানো হয়েছে ৩৬ টাকা। অথচ ১২০ থেকে ২৫০ টাকা মূল্যের রেইনকোট জাতীয় পণ্য কিনে পিপিই বলে হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়। ২০০৯ সালের পুরানো মডেলের পিসিআর মেশিন ক্রয় করা হয়। ওই মেশিনের মান নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে দুটি হাসপাতালের পরিচালকও অভিযোগ করেন। এভাবে বাড়তি মূল্য দেখিয়ে ঠিকাদারদের সঙ্গে জোগসাজশ করে পুরো অর্থ লোপাট করা হয়। আর এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত পুরো সিন্ডিকেটটিই মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের অনুসারী ছিলেন।
সবশেষে জাতীয় টেকনিক্যাল পরমর্শক কিমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, শুধু মহাপরিচালক পদত্যাগ করলেই হবে না এসব অনিয়মের সঙ্গে আরও যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত তাদেরকেও সরাতে হবে। একইভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনেক কাজে গাফিলতি ছিল সে ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া নতুন যারা আসবে তাদেরকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়ে দায়িত্বে বসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক আবুল কালামের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।