আন্তর্জাতিক জি নিউজ ডেস্ক।
বুধবার, ১৮ জুলাই ২০১৮:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। সেটিই ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ ঢাকা সফর। ওই অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেলও যোগ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল যার তৎকালীন নাম ছিল হোটেল শেরাটন। ২৫ মার্চ সকালে তিন দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছেই হোটেল শেরাটনে উঠেন ম্যান্ডেলা। সেখানে তাঁর কক্ষে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির।
আজ ১৮ জুলাই। আফ্রিকার এই কিংবদন্তি বিপ্লবীর শততম জন্মবার্ষিকী। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ম্যান্ডেলার এই দিনটিকে ঘিরে গোটা দুনিয়ায় নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এ দিনটিকে ঘোষণা করেছে ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে।
ম্যাল্ডেলার এই জন্মদিনকে ঘিরে মোহাম্মদ জমির স্মৃতিচারণ করলেন সেই দিনগুলোর। তিনি বলেন, ‘ম্যান্ডেলা আগে থেকেই জানতেন- আমি তাঁর রুমে আসছি। আমি রুমে ঢুকতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এর আগে বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় আমি তাঁর মুক্তি দাবি করেছি। ওই দিন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমাকে তাঁর একটি ছবি উপহার দিলেন। যেখানে লিখা ছিল- ‘মোহাম্মদ জমির, বেস্ট উইশেস টু আ ডিপেন্ডেবল ফ্রেন্ড।’
ম্যান্ডেলাকে সামনাসামনি দেখতে পাওয়াকে নিজের জীবনের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন দেশের গুণী শিল্পী ফকির আলমগীর। এমন কি তিনি ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান রচনা করেন। সেটি টের পেয়ে ম্যান্ডেলা তার সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছিলেন। পরে ফকির আলমগীর ম্যান্ডেলাকে সেই গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
ফকির আলমগীর বলছেন, ‘তখনকার প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে টেলিফোন করে হোটেল শেরাটনে আসতে বলেন। আমার স্ত্রীকেও নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কারণ বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে (প্রেসিডেন্টের নিমন্ত্রণে) নিজের হোটেল কক্ষে নেলসন ম্যান্ডেলা আমার সঙ্গে দেখা করবে। তখন দ্রুত ছুটে গেলাম শেরাটনে। অনেকেই দেখা করবে বলে লবিতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমাকে সরাসরি তার রুমে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি তখন বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। এবং নেমেই তিনি আমাকে বললেন, গানটা গাও। আমি যখন গানটা ধরেছি, তিনি আমার সঙ্গে আফ্রিকান ধরণে নাচতে শুরু করলেন, সেটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে।’
২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতার স্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মি. ম্যান্ডেলা। তার আগে অপর দুই নেতার সঙ্গে সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্প অপর্ণ করেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া বক্তব্যে তিনি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান মানুষের সংগ্রামের বর্ণনা তুলে ধরে বাংলাদেশ ও তাদের রাজনৈতিক, বাণিজ্য আর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি জানতে চান- একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশর অগ্রগতিও।
এর পর তিনি চলে যান বঙ্গভবনে। সেখানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত ভোজে অংশ নেন ম্যান্ডেলা। তবে তার খাবার খুবই পরিমিত ছিল।
কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশ সফরকালে ম্যান্ডেলাকে নিয়ে সবচেয়ে মজার তথ্যটি দেন মোহাম্মদ জমির।
তিনি বলেন, ‘ওইদিন বঙ্গভবনে খাবার টেবিলে বসে আলাপচারিতার ফাঁকে মি. ম্যান্ডেলা আমাকে বলেন, ‘শুনেছি আপনি আমের কথা বলেছিলেন এক জায়গায়। তো কই, আম কই?’ আমি বললাম, এখন তো মার্চ মাস, এখন আম হবে না। আপনি যদি মে মাসে কি জুন মাসে আসেন, তাহলে আম খাওয়াতে পারবো। তখন উনি খুব হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে এ মাসে আর আম পাওয়া যাবে না।
পরদিন ২৭ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এই বিপ্লবী। দীর্ঘ ২৭ বছরের জেলজীবন ছিল তাঁর। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বিশ্বের মানবতাকামী, বর্ণবাদবিরোধী সব মানুষের এই মহান নেতা। সূত্র: বিবিসি।