ভোট গণনা শেষে জানা গেল শেখ হাসিনা নন, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে বসলেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এই স্ববিরোধী মন্তব্যে গুরুত্ব না দেওয়ায়, স্বাভাবিক নিয়মে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। শেখ হাসিনা হন সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী।
খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে দেশের সমস্ত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই বিধান রেখে সংবিধানের সংশোধনী গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাই যে গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। এরপর বেশ কয়েকটি নির্বাচন এই ব্যবস্থা মোতাবেক অনুষ্ঠিত হয় এবং দেশের দুই প্রধান দল পালাক্রমে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাকেও এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলে। ইতিমধ্যে এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর আমলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হয়। এতে বিএনপি দুই প্রধান দলের মধ্যে অতীতে সমঝোতার লংঘন অভিযোগ এনে সে নির্বাচন বয়কট করে।
দেশের একটি প্রধান দল নির্বাচন বয়কট করায় সে নির্বাচন একটি নির্বাচনী প্রহসনে পরিণত হয়। জনগণ সে নির্বাচনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। প্রধান বিরোধী দল কর্তৃক বয়কটকৃত নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরের কথা, সরকারি দলের বহু নেতাকর্মীও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ তারা জানতেন তারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট দিতে দলের পক্ষ থেকে তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে।
বাস্তবে হয়ও সেটাই। ভোটদানের নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র প্রায় ফাঁকা, জনশূণ্য থাকলেও ভোটকেন্দ্র সরকারি দলের অল্প কয়েকজন নেতাকর্মী সরকার দলীয় প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সীলমেরে সরকার দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট অকল্পনীয় পর্যায়ে বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন। অথচ ভোট দানের নির্ধারিত সময়ে ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ফাঁকা, শূণ্য। পরবর্তী দিন ভোটদানের নির্দিষ্ট সময়ে ভোটকেন্দ্রের সমূহের এই জনশূণ্য সচিত্র প্রতিবেদন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে জনগণ প্রকৃত অবস্থা অবগত হবার সুযোগ পান।
এ কারণে জনগণ এ ভোটের নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ পরিচালনা করছে সেটা এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে, বিরোধী দলের বয়কটকৃত এই নির্বাচনে সংসদের মোট আসন সংখ্যার তিনশতের মধ্যে অধিকাংশ ১৫৩ আসনে সরকারি দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতি দ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন। জনগণের সমর্থন ধন্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় না গিয়ে সরকারি নেতৃবৃন্দ যে খুব লজ্জাবোধ করেন তাও নয়। সংসদে ভাষণ দান কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় একদিকে দিয়ে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের আবোল তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। বিরোধী দলীয় জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যকে যারা আবোল তাবোল বিবেচনা করতে পারেন, তারা যে গণতন্ত্রে আদৌ বিশ্বাস করেন না সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ গণতন্ত্রে বিরোধী দলের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
এখানে আর একটি বিষয়ও বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনার দাবীদার। কথায় বলে, দোষেগুণে মানুষ। অর্থাৎ মানুষ মাত্রেরই থাকে যেমন ভুল বা ত্রু টি, তেমনি থাকে গুণ বা সঠিক চিন্তা। কিন্তু সাধারণ মানুষ সাধারণত মানুষ তার নিজের দোষ বা ত্রু টি নিজে তা বুঝতে বা দেখতে পারে না। এই ভুল ত্রু টি বা দোষ তাকে দেখিয়ে দিতে পারে অন্যরা। সেই নিরিখে মানুষের ভুল ত্রু টি দেখিয়ে দিয়ে তারা তাকে দোষমুক্ত হতে তাকে সাহায্য করতে পারে। এটা কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজেই সম্ভব। সে সমাজে সমালোচনা নিষিদ্ধ, সে সমাজে কাউকে ভুল বা ত্রু টি থেকে মুক্তি করার কোন উপায় থাকে না। ভুলত্রু টির সমালোচনার উপায় না থাকলে এমন সমাজে কোন ত্রু টিপূর্ণ ব্যক্তির পক্ষে ভুল ত্রু টি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় থাকে না। এই যে ভুল ত্রু টি থেকে সমাজের মানুষকে মুক্ত করা এটাও শুধু গণতান্ত্রিক সমাজেই সম্ভব।
একথার গুরুত্ব কোথায়? গুরুত্ব এখানে যে, যেহেতু কোন মানুষই ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, সেহেতু মানুষকে ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হলে সমাজে ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দেয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সমাজে এই সুযোগ থাকে বলেই গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষ নিজেদের দোষত্রুটি সংশোধনের সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের ভুলত্রু টি থেকে মুক্ত করে চলতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যে সমাজে ভুল ত্রু টি অন্বেষণের সুযোগ নেই, সেখানে কোন ব্যক্তির কোন খারাপ অভ্যাস থাকলে সে বদ অভ্যাস সারা জীবনের মত তার জীবনে চেপে বসে। সে অভ্যাসের খারাপ দিক সে নিজে দেখতে পায় না বলে সে অভ্যাস থেকে তার মুক্ত উন্নত করার কোন সুযোগ পায় না সে।
এ জন্যই প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে যে কোন খারাপ মানুষেরও ভালো হওয়ার সুযোগ আসে, যদি সে নিজেও ভাল হতে চায়। এই যে মন্দ মানুষেরও ভাল হওয়ার সুযোগ, এর গুরুত্ব মোটেই কম নয়। এসব কারণেই খারাপ মানুষের ভাল হওয়ার সুযোগ যে সমাজে থাকে অর্থাৎ যে সমাজে কারো ত্রু টি অনুসন্ধান ও তা থেকে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করা সম্ভব। সেটাও একমাত্র গণতান্ত্রিক সমাজেই সম্ভব।
যে কথা বলে আজকের এলেখার ইতি টানতে চাই তা হল যেহেতু মানুষের মধ্যে ভাল মন্দ উভয় প্রবণতাই রয়েছে, সেহেতু তার মধ্যকার মন্দ প্রবণতা পরিহার করে চলার এবং ভাল প্রবণতা বাড়িয়ে চলার চেষ্টা করা সম্ভব। ইবলিসের মধ্যে ভাল পথে চলার প্রবণতা নেই বললেই চলে। একই ভাবে ফেরেস্তার মধ্যে মন্দ প্রবণতা নেই বললেই চলে। মানুষের মধ্যে ভাল মন্দ উভয় প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও সে যদি ভাল পথে চলতে চেষ্টা করে তার সেই চেষ্টার মধ্যে স্রষ্টা বেশী খুশী থাকেন। মানুষ হিসাবে আমাদেরকে স্রষ্টা ভাল মন্দ উভয় পথে চলার শক্তি দিয়েছেন। উভয় প্রকার শক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা যদিভাল পথে চলতে আন্তরিক চেষ্টা করি, নিশ্চয়ই আল্লাহর সন্তোষভাজন সম্ভাবনা আমাদের বাড়বে। আসুন আমরা সবাই স্রষ্টার সন্তোষভাজন হবার আন্তরিক চেষ্টা করি।